নীতিনির্ধারণী ড্যাশবোর্ড নিয়ে কাজ
যেটাকে মাপা যায় সেটাকেই ম্যানেজ করা যায়
দেশের নীতিনির্ধারণী ড্যাশবোর্ড নিয়ে লিখেছিলাম এর আগের বইগুলোতে বারকয়েক। আমার প্রিয় বিষয় বলতে পারেন। ম্যানেজমেন্ট গুরু ‘পিটার ড্রাকার বলেছিলেন অনেক আগে, যেটাকে মাপা যায় সেটাকেই ম্যানেজ করা যায়। অনেক ভেতরের কথা, সেখানে দেশের হাজারও কাজগুলোকে কোন নিক্তিতে মাপা যায়? মাপতে হবে কেন? সরকার তাহলে কিভাবে জানবে তাদের হাজারও প্রজেক্টের অগ্রগতি?
একদম ছোট ব্যবসায় উদ্যোক্তা যেখানে তার দিনের শেষে টালিখাতায় হিসেব ঠিক করে পরের দিনের কাজের হিসেব নেন সেখানে হাজার কোটি টাকার কাজে কী পঞ্চাশটা ড্যাশবোর্ড থাকবে না দেশের জন্য? আর কয়েকটা ইন্টিগ্রেটেড ড্যাশবোর্ড থাকবে সরকার প্রধানের কাছে? আর কতোদিন আমরা থাকবো পাওয়ারপয়েন্ট প্রেজেন্টেশনে যেখানে সব ডাটা ম্যানিপুলেশন করা যায়?
তথ্য আসবে সত্যিকারের শত শত সিস্টেমের ডাটাপয়েন্ট থেকে
এই কাজের অগ্রগতি/খরচের 'রিয়েলটাইম' ড্যাশবোর্ড পাল্টে দিতে পারে সামনের দিনগুলো। এখানে 'রিয়েলটাইম' বলা হচ্ছে যেহেতু ডাটা আসবে সত্যিকারের শত শত সিস্টেমের ডাটাপয়েন্ট থেকে। কর্তাব্যক্তিদের বানিয়ে বলার সুযোগ কম। কোথায় কাজের আগে টাকা ছাড় হয়েছে, অথবা কাজে কাদের অসহযোগিতার জন্য অগ্রগতি পিছিয়ে যাচ্ছে সেটার পরিস্কার ইনডিকেটর চলে আসবে ড্যাশবোর্ডে। সামনে কবে কী কী হতে পারে এবং কোথায় কোথায় কী সমস্যা হতে পারে সেটা বলে দেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
আগে কী লিখেছিলাম? ২০১৫ সালে। খুব একটা পাল্টায়নি কনটেক্সট। 'হাতেকলমে মেশিন লার্নিং' বইয়ে।
দেশের নীতিনির্ধারণী ড্যাশবোর্ড
আচ্ছা, বলতে পারবেন, একটা দক্ষ কোম্পানি কাজ করে কিভাবে? ঠিক বলেছেন। লাভ ক্ষতির ‘স্প্রেডশীট’ দিয়ে। ইনভেস্টমেন্ট এর প্রতিটা টাকার হিসেব থাকে তাদের কাছে। কোথায় লাভ ক্ষতি হচ্ছে সেটা জানা যায় সেই ‘স্প্রেডশীট’ থেকে। ছোট কোম্পানি হলে হিসেব রাখা সুবিধা। বড় হলে বাড়তে থাকে চ্যালেঞ্জ। শত শত ডিভিশন। প্রতিটার আলাদা আলাদা হিসেব। কোনটার ২% লাভ আর কোনটার ৮০% ক্ষতি এক কাতারের সেটা জানা দুস্কর বটে। আর তাই মাল্টি-মিলিয়ন/বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির ‘চীফ এক্সেকিউটিভ’দের কাছে থাকে ‘ড্যাশবোর্ড’। হাই-লেভেলের ধারণার জন্য। 'ইনফর্মড' ডিসিশনের জন্য। কোথায় কি হচ্ছে সেটার একটা ‘ব্রড পারপেক্টিভ’ হিসেব আসে ওখানে। আবার চাইলে ভেতরের খবর জানা যায় এক ক্লিকে।
একটা সফল ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান কাজ করে কিভাবে? ধরে নিচ্ছি গ্রামীনফোনের কথা। চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসারের কাছে আছে হাই লেভেল ড্যাশবোর্ড। প্রতিষ্ঠানের লাভ ক্ষতি, বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের কেপিআই’র কোথায় কে আছে - সামনের লক্ষ্য থেকে কতদূরে বা কাছে আছে কোম্পানি, তার সবকিছুই চলে আসে এই ড্যাশবোর্ডে। একটা “ইনফর্মড” সিদ্ধান্ত নিতে যা দরকার তার সব টুল দেয়া থাকে উনাকে। পাশাপাশি তার ড্যাশবোর্ডে থাকে টেলিনরের লক্ষ্যমাত্রা - যেটা আসলে মাতৃ কোম্পানির মূল ভাবধারা। প্রতিটা কোম্পানি চলে একটা দর্শনের ওপর। দর্শনকে ধরতে দরকারি নীতিমালা ঢুকে যায় ‘ক্যাসকেডিং’ স্টাইলে সবকিছুই ভেতরে। আবার ভেতরের সবকিছুই ‘ইন্টার-রিলেটেড’। বাংলাদেশের একটা সিম বিক্রিতে তার ‘ইমপ্যাক্ট’ দেখাতে পারে গ্লোবাল ড্যাশবোর্ডে। খুবই ছোট হতে পারে জিনিসগুলো। তবে, সবকিছু ইন্টার রিলেটেড। এক সুঁতোয় বাঁধা। সরকারের একটা নীতিমালা পাল্টালে সেটার ‘ইমপ্যাক্ট’ দেখায় আরো বড় ভাবে। যেমন, সিম ট্যাক্স বাড়লে - কমলে সেটার আউটকাম দেখায় ওই জায়গায়। মধ্যম লেভেলের ম্যানেজারদের কাছেও আছে তাদের সম্পর্কিত নিজস্ব ড্যাশবোর্ড। তার লেভেলে। যেখানে সে নিতে পারে ‘ইনফর্মড ডিসিশন’।
সরকারের ড্যাশবোর্ড হলে কি হতো এখানে? ডাটার ক্ষমতা অনেক। সেটা দেখতে পারে অনেক ভেতরের জিনিস। পৃথিবীতে প্রতিটা ঘটনা একে অপরের সাথে কানেক্টেড। ডাটা নিয়ে কাজ করি বলে বুঝতে পারি। অভাবের তাড়নায় কিশোরীর আত্মহত্যা থেকে শুরু করে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু সবকিছুর ইমপ্যাক্ট আসতে পারে ওই ড্যাশবোর্ডে। ‘ভিজিএফ’ কার্ড ঠিকমতো মাঠ পর্যায়ে বিতরণে কোথায় গিয়ে আটকে গিয়েছে সেটাও আসবে এখানে। আমাদের অতো ভেতরের খবর না হলেও চলে এমুহুর্তে। গ্রাম পর্যায়ের ডাটা পয়েন্টই যথেষ্ট এখন। সরকার প্রধান জানতে পারবেন ভেতরের অনেক খবর। ঘটার আগেই। সিঙ্গাপুরের “স্মার্ট নেশন” অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাতের “স্মার্ট গভ” প্রজেক্টের ড্যাশবোর্ড এখন পৌঁছে গেছে অন্য লেভেলে। সে দেশগুলোর সরকারি সার্ভিস ডেলিভারি প্ল্যাটফর্মের প্রায় পুরোটাই চলে এসেছে অনলাইনে। আমরাও আসছি আস্তে আস্তে। সেটার শুরুটা হতে পারে এই ড্যাশবোর্ড দিয়ে।
সরকার কি চালানো সম্ভব এভাবে? কোম্পানির মতো করে? সম্ভব। এদিকে অনেক কোম্পানি এখন সরকারের মতো করে চালাচ্ছে তাদের ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি’। মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে। মানে লাভটাই সবসময় মুখ্য নয়। আগে বলেছি - সিঙ্গাপুর থেকে শুরু করে অনেক দেশই হাতেনাতে দেখতে পাচ্ছে ডাটার ক্ষমতা। সত্যিকার অর্থে - সিঙ্গাপুরে আমার একটা রেগুলেটরি প্রশিক্ষণের পর খুলে গেছে মাথা। সে সব দেশে নীতিনির্ধারণে ডাটার ব্যবহার বাঁচাচ্ছে অনেক টাকা। অপব্যয় থেকে। ভুল সিদ্ধান্ত থেকে। ডাটা সাহায্য করছে সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত নিতে। একটা সময়পোযোগী সিদ্ধান্ত বাঁচাতে পারে অনেক টাকা। না হলে প্রজেক্টের টাকা বাড়তেই থাকে দিন কে দিন।
কেমন হয় এরকম একটা ড্যাশবোর্ড হলে? নীতিনির্ধারণী ডাটা ড্যাশবোর্ড। প্রধানমন্ত্রী, সংসদ সদস্য এবং সব আমলাদের জন্য। যার জন্য যেটা প্রযোজ্য। ২০০ এর ওপর থাকবে বিভিন্ন ডাটা পয়েন্ট। মন্ত্রণালয় সহ। ওই জায়গাগুলো থেকে যোগান দেয়া হবে ডাটা। এই ডাটাগুলোকে ‘কো-রিলেট’ করে মেশিন লার্নিং থেকে জানা যাবে জনগণের চাহিদা, কোথায় আসল সমস্যা, এবং সাংসদদের নিজ নিজ এলাকার কাজের 'গ্যাপ' অথবা ‘প্রোগ্রেস’। কোথায় আটকে আছে কাজ - কি সমস্যা, ভেতরের অসঙ্গতি - তার সবকিছুই চলে আসবে আমাদের ড্যাশবোর্ডে। ফলে সিদ্ধান্তগুলো হবে ‘ইনফর্মড’, মানে জেনে সিদ্ধান্ত দেয়া। আমার ডাটা বলছে ভারতে এধরণের ড্যাশবোর্ড মানে ‘ডাটা ড্রিভেন গভর্নেন্স’ চালু হয়েছে অন্ধ্র প্রদেশ, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড আর মহারাষ্টে। সাহায্য করছে একটা বেসরকারি সংস্থা।
২০০৮ সালের কথা। স্পেকট্রাম ম্যানেজমেন্ট নিয়ে একটা প্রশিক্ষনে গিয়েছিলাম মার্কিন যুক্তরাস্ট্রে। সেখানেই প্রথম দেখলাম ড্যাশবোর্ড, কিভাবে একটা দেশ স্পেকট্রাম ম্যানেজ করে। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, সব রিয়েল টাইম, সফটওয়্যারে। তিন ধরে ড্যাশবোর্ড ব্যবহার হয় সরকারে।
তিন ধরনের ড্যাশবোর্ড
- অপারেশনাল (যা দিয়ে সবকিছু মনিটর করা যায় রিয়েল টাইম, যেমন পুরো দেশের ট্রাফিক ড্যাশবোর্ড, যা দিয়ে ট্রাফিক, সড়ক দুর্ঘটনা, বন্যার অবস্থা, নতুন রাস্তা - যখন একটা রাস্তা বন্ধ হয়, ঈদের ট্রাফিক - বাস, ট্রেন, লঞ্চএর রুট জানানো যাবে জনগণকে)
- ট্যাকটিকাল (এগুলো সাধারণত মনিটরিং এবং বেঞ্চমার্কিং এর জন্য ব্যবহার করা হয় অন্যান্য ড্যাশবোর্ড এর সাথে সাথে)
- স্ট্রাটেজিক (সরকারের বড় লেভেলের কৌশলগত ব্যবস্থাপনাগুলোকে ঠিকমতো মেপে সেটার কৃতিত্বগুলোকে ট্র্যাকিং করার জন্য)
-
ঠিক কে এ কথাটা বলেছেন এ নিয়ে মতোবিরোধ থাকলেও কথাটা একদম ঠিক। 'হারভার্ড বিজনেস রিভিউ' উনাকে 'কোট' করেছেন ২০১০ সালে। ↩