অ্যাডাপ্টিভ লার্নিং সিস্টেম - কাদের জন্য?
আমাদের ‘রকষ্টার’ কারা?
আমি যখন স্কুলে এবং পরে ক্যাডেট কলেজে গেলাম, এর পাশাপাশি এখন যখন আমার বাচ্চাদের স্কুলের শিক্ষকদের দেখছি বিভিন্ন মিডিয়ামে (ক্লাসে এবং ভিডিও কনফারেন্সে), এখন বুঝতে পারছি কিছু কিছু শিক্ষক আছেন যারা অনেকটাই আমাদের সময়ের ‘রকস্টার’দের মতো। ছোটবেলায় প্রচুর রক ব্যান্ড এর গান শুনতাম, এখন উনাদের লেসন ডেলিভারি দেখি সময় পেলে।
কিছু কিছু শিক্ষকদের ‘রকস্টার’ বলছি এ কারণে, তাদের শেখানোর ডেলিভারি আমি দেখেছি মন্ত্রমুগ্ধের মত। যাদের ক্লাস বারবার করতে ইচ্ছে হয়। সেই রক গান শোনার মত, যেগুলো আমরা শুনতাম ‘রিওয়াইন্ড’ করে বার বার। আর যারা একটা জাতির ‘বেসলাইন’ তৈরি করে দিচ্ছেন তারা কেন 'রকস্টার' হবেন না? একটা জাতিকে সামনের ভেঞ্চারে নিতে দরকার 'রকস্টার' লেভেলের শিক্ষকদের।
এতদিন এই ধরনের শিক্ষকদের কাজকে স্কেল করা যেত না প্রযুক্তির অভাবে। ব্যাপারটা এমন যে একটা ক্লাসে ২০/২৫ জনের বেশি ছাত্রকে একজন শিক্ষক ঠিকমতো দেখভাল করতে পারেন না, সেখানে প্রযুক্তির সাহায্যে ব্যাপারটাকে কতোটা অপটিমাইজড এবং ‘পার্সোনালাইজড’ করা যায় সেটা নিয়ে আলাপ করছি সামনে। সনাতন ক্লাসে আমরা যেভাবে ক্লাসে ‘ওয়ান সাইজ ফিট্স অল’ লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স দিতে চাই, সেটা যাচ্ছে ভেঙ্গে।
শেখার প্রাসঙ্গিকতা, প্রযোজ্যতা, প্রাসঙ্গিকতা এবং যথোপযুক্ততা
Learners in the Internet age don’t need more information. They need to know how to efficiently use the massive amount of information available at their fingertips – to determine what’s credible, what’s relevant, and when its useful to reference.
-- Anna Sabramowicz
একজন শিক্ষার্থী : একজন শিক্ষক = সেরা লার্নিং অভিজ্ঞতা
চলুন আমরা একটা জিনিস ভিজুয়ালাইজ করি। একজন শিক্ষার্থীকে একজন শিক্ষক পড়াচ্ছেন একটা ঝামেলাপূর্ণ কনসেপ্ট নিয়ে। আবারো বলছি, একজন শিক্ষার্থী এবং একজন শিক্ষক। পুরো সময় আমাদের শিক্ষক উনার শেখানোর ডেলিভারি স্টাইল পরিবর্তন করতে থাকবেন প্রতিমুহূর্তে যখন শিক্ষার্থী কিছু কিছু সময় মুখে রেসপন্স দেবেন। অথবা কিছু কিছু সময় শিক্ষার্থীর দৈহিক এবং তার মুখভঙ্গি বুঝে উনার শেখানোর পদ্ধতি পাল্টাবেন। পুরো ব্যাপারটি একটা রিয়েল টাইম কমিউনিকেশন যেখানে শিক্ষার্থী ঠিকমতো বুঝতে পারছেন কি পাচ্ছেন না সেটার ওপর ভিত্তি করে শিক্ষক একেক সময় একেক ধরনের ডেলিভারি মেকানিজম ব্যবহার করছেন শিক্ষার্থীর বোঝানো নিশ্চিত করতে।
কিছু কিছু সময় উনি শেখানো বন্ধ রেখে শিক্ষার্থীর কাছ থেকে নতুন প্রশ্ন নিয়ে সেটাকে ‘কন্টেক্সটুয়ালি’ এবং ‘কন্টেক্সট’ এর বাহিরে গিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছেন, পাশাপাশি নতুন রেফারেন্স নিয়ে আসছেন যাতে শিক্ষার্থী তার জানা রেফারেন্স ধরে ব্যাপারটাকে কানেক্ট করতে পারেন। শিক্ষার্থী কোন ব্যাপারে উৎসাহ বা ‘বোরিং’ ফিল করছেন সেটাকেও লক্ষ্য রাখছেন আমাদের শিক্ষক। যখন একজন শিক্ষার্থীর সাথে একজন শিক্ষক থাকেন তখন পুরো ব্যাপারটাই ‘ফ্লেক্সিবল’ থাকে।
আমাদের উপরের উদাহরণে শিক্ষার্থীর বিভিন্ন ইনপুট, সেটা মৌখিকভাবে হোক অথবা তার ভঙ্গিমা থেকে হোক - তার উপর ভিত্তি করে আমাদের শিক্ষক পাল্টাচ্ছেন তার অ্যাডাপটিভ শেখানোর অভিজ্ঞতা। দেখা গেছে একজন বা দুইজন শিক্ষার্থীকে যে কোন একটা সময়ে একজন শিক্ষকই পারেন ঠিকমতো লার্নিং এক্সপেরিয়েন্স শেয়ার করতে। যতোবেশি শিক্ষার্থী বাড়বে ততই কম একজন শিক্ষক তার শেখানোর অভিজ্ঞতা প্রতিটা শিক্ষার্থীকে দিতে পারবেন। এবং প্রযুক্তি ছাড়া এটা সম্ভব নয়।
লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এল এম এস) এর উত্থান
গত ৩০/৪০ বছর ধরে শিক্ষাকে কিভাবে ১০০ ভাগের ১০০ ভাগই শিক্ষার্থীদের কাছে নেয়া যায় সেটা নিয়ে অনেক রিসার্চ হয়েছে। শিক্ষা থেকে তার ‘রিটেনশন’ এবং সেই জ্ঞানকে ঠিকমতো লাগাতে পারছে কি না সেটাও নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে। সেখানে অনেকগুলো ট্রাকের মধ্যে প্রযুক্তিগতভাবে ‘অ্যাডাপটিভ লার্নিং সিস্টেম’ বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। আমি নিজেও বেশ কয়েকটা লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এল এম এস) দেখেছি, সেখানে অনেক মডিউল দেখলে মাথা খারাপ হবার কথা। একটা স্কুল যদি এধরণের লার্নিং ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ঠিকমতো চালাতে পারে, তাহলে সব শিক্ষকরা আসলেই ‘রকষ্টার’ হতে পারবেন। এদিকে শিক্ষার্থীরাও বসতে পারবেন যেকোন কম্পিটিটিভ এক্সামে, একদম হাসতে হাসতে।
একটা কথা বলে রাখা ভাল, সনাতন ই-লার্নিং কোর্স এর সাথে এই ‘অ্যাডাপটিভ লার্নিং সিস্টেম’কে একদমই মেলানো ঠিক হবে না। এটা ঠিক যে আমার গত ২০ বছরে প্রচুর ই-লার্নিং প্লাটফর্ম ব্যবহার করার সুযোগ হয়েছে, আর সেকারণে বুঝতে পারি কেন এই সনাতন ই-লার্নিং প্লাটফর্মগুলো সেভাবে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি। প্রচুর শিক্ষার্থী এই ধরনের কোর্সগুলোতে ‘সাইন আপ’ করেছেন তবে শেষ পর্যন্ত থাকেননি শুধুমাত্র সিস্টেমগুলো ঠিকমতো সবার সাথে অ্যাডাপ্ট করতে পারেনি। আমি এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের থেকে সিস্টেমের অ্যাডাপশন লেভেলের সমস্যার কথা বলবো। যন্ত্রের কাজ হচ্ছে মানুষের সাথে অ্যাডাপ্ট করা, এর উল্টোটা হবে না, মানে মানুষ যন্ত্রের সাথে অ্যাডাপ্ট করবেনা।
বর্তমানে ই-লার্নিং কোর্সগুলোতে কি হয়? একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা বইয়ের মতো একটা ‘টেবিল অফ কনটেন্ট’ ফলো করি যেটা সেই শিক্ষক তৈরি করে দেন। আমরা সেই ‘লিনিয়ার’ ‘টেবিল অফ কন্টেন্ট’ দেখে ভিডিও, আর্টিকেল, কুইজ এবং অসংখ্য ইন্টারেক্টিভ মডিউল প্র্যাকটিস করি। আর, এ সবকিছুই তৈরি করা থাকে আগে থেকে একটা নির্ধারিত ‘অর্ডারে’ মানে একটা স্পেসিফিক ক্রমানুসারে। সেই ক্রম ভাঙ্গার সুযোগ নেই শিক্ষার্থীদের। আর সেখানেই সমস্যা। শেখার ইচ্ছে হারিয়ে ফেলেন শিক্ষার্থীরা।
‘অ্যাডাপটিভ লার্নিং সিস্টেমে’র জাদু কোথায়?
সেদিন থেকে ‘অ্যাডাপটিভ লার্নিং সিস্টেমে’ একই ধরনের কন্টেন্ট’ থাকলেও সেটার ক্রম এবং কোন ভিডিও অথবা আর্টিকেল, কুইজ, কতোটুকু শিখেছেন সেটার অ্যাসেসমেন্ট এবং কোন স্পেসিফিক মডিউলের দরকার আছে কি না সেটা নির্ধারণ করবে সিস্টেমের অ্যালগরিদম। ব্যাপারটা এরকম যে শিক্ষার্থী কি শিখতে চাচ্ছেন অর্থাৎ তার "লার্নিং গোল” এবং ওই বিষয়ের উপরে তার বর্তমান জ্ঞান কোথায় আছে সেটার মধ্যে একটা ‘ম্যাপিং’ করে তার জন্য প্রয়োজনীয় কনটেন্ট ডেলিভারি করবে এই অ্যাডাপটিভ লার্নিং সিস্টেম’। ব্যাপারটা আরো দক্ষতা দেখাবে যখন সে শিক্ষার্থীদের ঠিকমতো চিনবে গুগলের মতো! ভয় পাচ্ছেন? সিস্টেম আপনাকে যতো ভালোভাবে চিনবে - ততো মনের মতো করে শেখাবে জিনিসটা।
আমরা এর একটা ডেফিনিশন দাঁড়া করাতে পারি। ১. এটা একটা টেকনোলজি ‘এনাবলড’ পার্সোনালাইজড লার্নিং প্ল্যাটফর্ম - একেকজনের জন্য একেকরকম, ২. যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং দরকারি অ্যালগরিদম ব্যবহার করে শিক্ষার্থীদের শেখার কনটেন্টকে রিয়েল টাইম পরিবর্তন করতে থাকে, ৩. শিক্ষার্থীদের রিয়েল টাইম ইনপুট এর উপর ভিত্তি করে।
সবার জন্য ‘পার্সোনালাইজড’ লার্নিং
এখন প্রশ্ন আসতে পারে ‘পার্সোনালাইজড’ লার্নিং কি হতে পারে? এটা এমন একটা সিস্টেম যা প্রতিটা শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ‘ইন্টারেস্ট’ এর পাশাপাশি সেই বিষয়ের উপরে আগে ‘এক্সপেরিয়েন্স’ আছে কিনা সেটা জেনে তার জন্য কি ধরনের লার্নিং মেথডোলজি ব্যবহার করতে হবে - সেটার একটা ধারণা, এবং শেষে সেই শিক্ষার্থীদের নিজস্ব শেখার গতির পাশাপাশি কিভাবে এই জিনিসটা অন্য কোথাও ইমপ্লিমেন্ট করবেন সেটার একটা ধারণা নিয়ে আসা। যা শিখবেন সেটার একটা রিয়েল ওয়ার্ল্ড কানেকশন বের করে দেবে সে।
ব্যাপারটা একটু খোলাসা করি। ১. যদি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্য মানে ‘গোল’ থাকে পুরো কনটেন্ট এর মধ্যে একটা অংশবিশেষ শিখবে তাত্ক্ষণিক, তাহলে এই সিস্টেম স্বয়ংক্রিয়ভাবে বাকি জিনিসগুলোকে শিক্ষার্থীদের দেখানো থেকে বিরত থাকবে। মানে ‘ইনফরমেশন ওভারলোড’ করবে না শিক্ষার্থীদের উপর। ২. অ্যাডাপটিভ লার্নিং এর একটা বড় অংশ হচ্ছে শিক্ষার্থীদের ‘ওই বিষয়ে আগের কোনো জ্ঞান আছে কিনা’ সেটার ধারণা নেয়া। যদি সিস্টেম বুঝে যায় যিনি শিক্ষার্থী তার ওই বিষয়ে আগে কিছু অভিজ্ঞতা আছে তাহলে সেই শিক্ষার্থীদের জন্য আলাদা করে কোর্স কনটেন্টকে ‘অপটিমাইজ’ করে ফেলবে - যেখান থেকে তার ‘নলেজ গ্যাপ’ শুরু। এই ‘নলেজ গ্যাপ’ নিয়ে আলাপ করা হয়েছে আগে।
পাল্টে যাচ্ছে স্কুল!
The technology itself is not transformative. It’s the school, the pedagogy, that is transformative.
-– Tanya Byron
‘অ্যাসেসমেন্ট’ - ওই বিষয়ে আমরা আছি কোথায়?
আর সে কারণেই এধরনের সিস্টেমের শুরুতে শিক্ষার্থীদের ‘অ্যাসেসমেন্ট’ করে নেওয়াটা একটা বাধ্যতামূলক বিষয়। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে শিক্ষার্থী ওই বিষয়ে এখন কোথায় আছেন এবং তার জন্য ট্রেনিংটা কোন পর্যায় থেকে শুরু করলে তার সুবিধা হয়। এটাকে বলতে পারেন একটা ‘মেজারিং টুলস’ যেখানে অ্যাডাপটিভ লার্নিং এর অ্যাসেসমেন্টের ইনপুট, সিস্টেমের ফিডব্যাক হিসেবে ঢুকে যাবে তার প্রয়োজনীয় টেকনোলজিক্যাল কম্পনেন্টে। সে হিসেবে ‘ডাইনামিক্যালি’ আপডেট হবে পরবর্তী মডিউল।
তবে, আসল মজা সামনে। আমাদের বর্তমান স্কুল সিস্টেমের সাথে ব্যাপারটা 'কমপ্লিমেন্ট' করে পুরোপুরি। আমাদের ‘রকষ্টার’ শিক্ষকগণ এটাকে ব্যবহার করে শিক্ষাকে নিয়ে যেতে পারবেন নেক্সট লেভেলে।