কনটেন্টে যান

শিক্ষার বর্তমান অবস্থা (পৃথিবীব্যাপী)

শেখার মতো শেখা

Education is what remains after one has forgotten what one has learned in school.

– Albert Einstein

খান একাডেমির ধারণা

এ থেকে বাঁচার উপায় কী? সেটার একটা সদুত্তর পাওয়া গেছে সালমান খানের কাছে। আমি ব্যাপারটাকে শতভাগ সমর্থন করি। কারন আমি নিজেও প্রতিটা জিনিস মাস্টার না করে পরবর্তী পর্যায়ে যাবার ব্যাপারে অনীহা পোষণ করি। সেটা ক্লাসের পড়া অথবা যে জিনিসটা নিয়ে আমি পড়ে থাকি। সত্যি কথা বলতে - একটা জিনিস ভালোভাবে না শিখে ক্লাসের পর ক্লাস পাড়ি দিলে সেই বিষয়গুলোর ফাউন্ডেশন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে বাধ্য।

উনি বলছিলেন জীবনে আমরা প্রচুর জিনিস শিখি মানে ‘মাস্টারিং’ করি আমাদের মনমতো লেভেলে শেখার জন্য। আমরা ‘মার্শাল আর্টে/কারাতে’তে ‘হোয়াইট বেল্ট’ স্কিল থেকে পরের স্কিলে যাবার জন্য যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই প্র্যাকটিস করবো, অর্থাৎ হোয়াইট বেল্ট থেকে একটা নির্দিষ্ট স্কিলসেট না পেলে ‘ইয়োলো বেল্টে’ যাওয়া যাবেনা। সময় নয়, যেমন উদাহরণ হিসেবে ১ বছর হলেও আপনি ইয়েলো বেল্টে যেতে পারবেন না যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি তার নির্দিষ্ট স্কিলসেট তৈরি করতে পারবেন।

মাস্টারিং স্কিলসেট

এখানে স্কিলসেটটাই ইম্পর্টেন্ট, সময় নয়। ব্যাপারটা এরকম না যে আপনি এক বছরের মধ্যে যতটুকু আয়ত্ত করা যায় সেটা নিয়েই চলে যাবেন ইয়োলো বেল্টে। এর অর্থ হচ্ছে, একটা নির্দিষ্ট স্কিলসেট তৈরি না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী লেভেলে যেভাবে যাওয়া হচ্ছে না, সেখানে আসলে সময়টা নির্ভর করছে যিনি ব্যাপারটা শিখছেন। উনি বেশি মনোযোগ দিলে আগে শিখবেন - না হলে আগের লেভেলেই পড়ে থাকবেন।

এই একই জিনিস প্রযোজ্য হতে পারে আপনার গান শেখার ক্ষেত্রে। যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি একটা ব্যাপারে পারফেক্ট “লয়”, “তাল” তুলতে না পারছেন ততক্ষণ পর্যন্ত আপনি নিজে থেকেই পরের স্টেজে যাবার চিন্তা করবেন না। গলার ‘কাজ’ ঠিকমতো না করে অর্থ্যাৎ প্রয়োজনীয় ‘প্র্যাকটিস’ না করে স্টেজে গেলে আপনার গান বেসুরো শোনাবে। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে আপনি হয়তোবা সেই রিস্কটা নেবেন না।

আমাদের সনাতন শিক্ষা

এখন আসি আমাদের সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থাতে। এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে একটা সময়ের মধ্যে যতোটুকু বাচ্চারা শিখতে পারে সেটাতেই সই আমরা। উদাহরণ দেই বরং। পুরো ব্যাপারটা শুরু হয় যখন কাছাকাছি বয়সের বাচ্চাগুলোকে একটা ক্লাসে নিয়ে আসি আমরা। ধারণাটা এরকম যে - পাশাপাশি বয়সের সব মানুষের জিনিসপত্র বোঝার ক্ষমতা (পারসিভনেস) প্রায় একই থাকে। সাধারণভাবে ধরে নেই একটা ক্লাসে যদি ৫০ জন বাচ্চা থাকে, তাদের শিক্ষক অ্যালজেবরার শুরুর দিকের কিছু অংশ (ধরা যাক, এক্সপোনেন্টের ওপর) শিখিয়ে দেন, তারপর কি হতে পারে?

বাচ্চারা বাসায় গিয়ে কিছু হোমওয়ার্ক করবে সেই এক্সপোনেন্টের ওপর, এর উপর গ্রেডিং হতে পারে পরের দিন। সেই গ্রেডিংয়ে কেউ ৫০, কেউ ৬০, কেউ ৯০ পেল। পরের দিন সেই হোমওয়ার্ক এর উপরে কিছু ধারনা নিয়ে আবার নতুন করে লেকচার - হোম ওয়ার্ক - লেকচার - হোমওয়ার্ক এভাবেই চলতে থাকবে যতদিন পর্যন্ত একটা সময় পর ফাইনাল টেস্ট না এসে হাজির হয়। সবকিছুর জন্যে একটা সময় বেঁধে দেয়া থাকে বলে, সবাই এক বিষয়ে পুরোপুরি জানার আগেই তাদেরকে বিষয়টাকে শেষ করতে হয়। টেস্টের রেজাল্ট দেখা গেল সেই গ্রেডিং এর মত কেউ ৪০, ৫০, কেউ ৬০, কেউ ৯০ পেল। ধরুন, আমি পেলাম ৭০ এর ঘরের মার্ক।

জ্ঞানের গ্যাপ এর যোগফল কতো?

মজার কথা হচ্ছে আমাদের এই ‘টেস্ট’ (কোন টেস্ট ১০০% গ্যাপ করতে না পারলেও) এই ক্ষেত্রে সবারই জ্ঞানের গ্যাপ যতটুকু বের করতে পেরেছে সেটা একেকজনের জন্য একেক রকম। আমরা এটাও জানি যে টেস্ট একটা মানুষের পুরোপুরি জ্ঞানের গ্যাপ ধরতে পারে না, তবুও তর্কের খাতিরে আমরা ধরে নিচ্ছি এই টেস্ট থেকে যারা ৪০% পেয়েছিলেন তারাও ভর্তি হচ্ছেন উপরের ক্লাসে। মানে উপরের ক্লাসে চলে যাচ্ছেন ওই একটা সাবজেক্টে ৬০% নলেজ গ্যাপ নিয়ে। এগুলোকে যখন আমরা প্রতিটা বিষয় ধরে ধরে যোগ করি তখন দেখা যাবে সবগুলো সাবজেক্ট এর প্রায় ৫০% নলেজ গ্যাপ নিয়ে আমরা চলে যাচ্ছি পরের অ্যাডভান্সড ক্লাসে।

যেহেতু আগের প্রতিটা সাবজেক্টের সাথে পরের ক্লাসের নতুন অ্যাডভান্স সাবজেক্ট সরাসরি কানেক্টেড, সেখানে আমরা নতুন বিষয় (উদাহরণ হিসেবে বলছি) ‘লগারিদম’ অথবা ‘নেগেটিভ এক্সপোনেন্টে’র ব্যাপারগুলো বুঝতে আমরা আগে থেকেই পিছিয়ে আছি প্রায় ৫০%। ফলে নতুন ক্লাসে নতুন অ্যাডভান্সড অংশগুলো বুঝতে আমাদের ভেতরে সমস্যা হচ্ছে বলেই আস্তে আস্তে আমাদের মধ্যে অনেকেই সরে যাচ্ছেন অংক, পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞানের মত অনেক অসাধারণ বিষয় থেকে।

ব্যাপারটা এরকম যে ফাউন্ডেশন বিষয়গুলোর প্রায় ৫০% না জেনে আমরা চলে যাচ্ছি তারপরের অ্যাডভান্সড স্টেজে। ফলে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে আমাদের আগ্রহ তৈরির বদলে আমরা দূরে সরে যাচ্ছি ভয়ে। বাচ্চাগুলোর পাশাপাশি তাদের বাবা-মাও ভাবছেন আমাদের বাচ্চাদের অংকের ‘জিন’ নেই। অথচ এই অংক যেকোনো ‘কারাটে’ বা ‘পিয়ানো লেসন’ এর মত ফাউন্ডেশনের অংশগুলোকে ঠিকমতো শিখে পরের ধাপে যাওয়া হলে এ ব্যাপারগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠতো না।

প্রতিটা বাচ্চার পারফরমেন্স আলাদা করে ‘মনিটর’ করার টুলের অভাব

ছাত্র নাকি ক্লাস?

Teach to the student, not to the class.

একটা ব্যাপার লক্ষ্য করুন, প্রতিবছর - প্রতিটা বাচ্চার আলাদা করে তার নলেজ গ্যাপ বের করা সত্ত্বেও আমাদেরকে তাদেরকে ঠেলে দিতে হয়েছে উপরের ক্লাসে। কারণ, একটাই। আমাদের সেরকম রিসোর্স এবং শিক্ষকদের ‘লার্নিং টুল’ ছিল না যা দিয়ে প্রতিটা বাচ্চার পারফরমেন্স ঠিকমতো ‘মনিটর’ এবং সেটাকে ব্যবহার করে তার প্রতিটা বিষয়ে কতটুকু গ্যাপ পড়েছে আর কতটুকু যোগ করলে সেটাকে অল্প সময়ে কাভার করে নেওয়া সম্ভব। এখন সেই টুলগুলোর অভাবে প্রতিটা ক্লাসের ২০-৩০% করে ফাউন্ডেশন ধারণা মিস করতে করতে বড় হতে থাকবে সমস্যাটা। তারপর স্পেশালাইজড বিষয় নিয়ে পড়ার চিন্তা বাদ।

ধরুন আমি ৫ম ক্লাসে পড়ছি। আগের সেই নলেজ গ্যাপের ব্যবস্থায় যখন প্রতি মাস প্রতি বছর ঘুরে ঘুরে একটা অ্যালজেবরা অথবা ত্রিকোণমিতি ক্লাসে এসে পড়লাম, তখন আমার সামনে সবকিছু সাদা। কিছুই মাথায় আসছে না। অর্থাৎ আমার সামনে ফিজিক্যালি একটা অদৃশ্য ‘দেওয়াল’ দাঁড়িয়ে গেছে। আমি কোন কিছুই বুঝতে পারছিনা। আশেপাশে কিছু কোচিং করে হয়তোবা কাভার করে নিলাম, তবে বিভিন্ন বিষয়ে বড় বড় গ্যাপের কারণে অংকের মতো একটা সাধারন বিষয়কে ছেড়ে দিলাম আমাদের জীবন থেকে।

এই একই ধারণা থেকে পিছিয়ে পড়েছে আমাদের বাচ্চারা - যখন প্রোগ্রামিং করতে গিয়েছে। তাদের ধারণা তাদের মধ্যে প্রোগ্রামিং ‘জিন’ নেই, অথবা প্রোগ্রামিং বোঝার মাথা নেই তাদের। ব্যাপারটা এরকম কখনোই নয় যে - অংক অথবা প্রোগ্রামিং ‘ফাউন্ডেশনালি’ কঠিন, অথবা বাচ্চাগুলোর এই ব্যাপারগুলো বোঝার সামর্থ্য নেই। যে জিনিসটা বোঝা গেছে - এভাবে সবাই প্রায় ছেড়ে দিয়েছেন তাদের প্রিয় বিষয়গুলো - এই বড় বড় গ্যাপের কারণে। কারণ এই আমরা বিশ্বাস করেছি ‘আমরা’ অংকের বা প্রোগ্রামিংয়ের যোগ্য নই। অথচ, আমি যখন ব্ল্যাকবোর্ডে একটা ইকুয়েশন দেখছি সেখানে এক্সপোনেন্টের সাথে আরো অনেক কিছু চলে এসেছে যেটা ওই মুহুর্তে ভালো বুঝি না। শুরু হলো মাথার ‘সুইচ অফ’ করে দেয়া। অর্থাৎ ছেড়ে দিলাম মনোযোগ - ভেবে এই বিষয়টা আমার জন্য নয়।

বাসার ৪০% বাদ দিয়ে ফাউন্ডেশন দেবেন কী আপনি?

ব্যাপারটা একটা কয়েক তালা বাড়ি বানানোর মতো বলা যেতে পারে। ৪০% বাদ দিয়ে ফাউন্ডেশন দেয়া হলো শুরুতে। গল্পটা একটু বড়, চলুন পরের চ্যাপ্টারে।

আমি 'প্রযুক্তি কী করতে পারছে' এবং 'বর্তমান স্কুলিং সিস্টেম'কে মুখোমুখি দাড়া করাতে চাচ্ছি না। বরং প্রযুক্তিকে ব্যবহার করতে চাচ্ছি একে অপরের পরিপূরক হিসেবে। একটা হাইব্রিড মডেল, যেখানে শিক্ষকের টুল হিসেবে কাজ করবে কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি ঐতিহাসিকভাবে নতুন প্রযুক্তি নেবার ব্যাপারে অনেক ধীরগতি সম্পন্ন - তবে আমরা মনে করি এটা ভাল জিনিস। বিশ্ববিদ্যালয়গুলি স্টার্টআপ নয় যা সিলিকন ভ্যালির 'ফেইল ফার্স্ট' স্টাইলে চলবে। এছাড়াও শিক্ষা নিয়ে প্রচুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করার সুযোগ কম। সেই সুযোগ এসেছে এখন, সিমুলেশন করে নিতে পারবো নতুন শিক্ষা নীতিমালা নিয়ে। আসল শিক্ষার্থীদের ওপর না দিয়ে।