জাতীয় পরিচয়পত্র, ড্রাইভিং লাইসেন্স এবং পাসপোর্ট
নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র এর কাজের পরিধি
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশনের আওতায় জাতীয় পরিচয়পত্র কাজ শুরু করলেও এর পরিধি অনেক ব্যাপক। এর বিশালতা এখন বোঝা না গেলেও সেটা দেখা যাবে সামনের ৩ বছরে। নির্বাচন কমিশনের কাজের সাথে জাতীয় পরিচয়পত্রের ব্যাপারটি সাংঘর্ষিক না হলেও আইনগত কর্মপরিধি দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রকে সেভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। জাতীয় পরিচয়পত্রের সঠিক জনবল থাকলেও এর ব্যবহারের আইনগত ভিত্তি সেভাবে জোরালো হচ্ছে না কারণ নির্বাচন কমিশনের ম্যান্ডেট হিসেবে নির্বাচনের জন্য পরিচয়পত্র ব্যবহার করলেও পুরো দেশব্যাপী প্রতিটা সার্ভিসের জন্য সেভাবে বাধ্যবাধকতায় আনা যাচ্ছে না। অন্যান্য দেশের ‘বেস্ট প্র্যাকটিস’ অর্থাৎ সেরা অনুশীলনগুলো দেখলে এধরনের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রোগ্রামের বিশালতা ব্যাপক। আর সে কারণেই ভবিষ্যতে জাতীয় পরিচয়পত্র বিষয়টি অন্য সংস্থায় যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা আমার অভিজ্ঞতার কথা।
পুলিশ ভেরিফিকেশন এবং ডাটাসেটগুলোর সংযোগের সুবিধা
একটা উদাহরণ নিয়ে আসি। বাংলাদেশে অনেকগুলো কাজের জন্য আন্ত:সংস্থাগুলোকে পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য কাগজ প্রসেস করতে হয়। ধরা যাক, আপনি যদি পাসপোর্ট এর জন্য আবেদন করেন, সেখানে সেই পাসপোর্টের আবেদনের পরে সেখানে একটি পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন পড়ে। আমরা যেহেতু কাজের প্রসেসগুলোকে সহজীকরণ পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি, সেখানে দেখছি - পাসপোর্ট একজন নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার। সেকারণে আমরা ধরে নিতে পারি, পাসপোর্ট পাবার জন্য একজন মানুষের পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন নেই। তবে সরকারি নীতিমালায় যেহেতু ব্যাপারটা আছে সেখানে তার যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলা যায়। কেন ‘পুলিশ ভেরিফিকেশন’ প্রয়োজন? এখানে প্রযুক্তির ব্যাপারে একটু পরে আলাপ করা যেতে পারে। আইনগত অথবা দেশের নিরাপত্তাজনিত কারণে একজন নাগরিককে দেশ ত্যাগে বাধা দিতে চাইলে সেখানে পাসপোর্ট যেসব সীমান্তে অর্থাৎ ‘বর্ডার কন্ট্রোল’ অংশে ব্যবহার হয় সেখানে তার পাসপোর্ট এর এক্সেস বন্ধ করে দিলেই এই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সমস্যাটা থাকছে না।
একজন নাগরিক যদি পাসপোর্ট এর জন্য আবেদন করে তাহলে রাষ্ট্র তাকে পাসপোর্ট দিতে বাধ্য। তবে, সেই নাগরিকের দেশত্যাগে অথবা তার ব্যাপারে কোন আইনি বাধ্যবাধকতা থাকলে সেই পাসপোর্টটাকে যেকোনো ইমিগ্রেশন ‘বর্ডার কন্ট্রোল’ যেমন এয়ারপোর্ট অথবা সীমান্ত চেকপোস্ট দিয়ে পার হবার সময় তার পাসপোর্ট এর কার্যকারিতা ‘রহিত’ করা যেতে পারে। ফলে, এখানে তার নাগরিক অধিকার ক্ষুন্ন হচ্ছে না। এই উদাহরণ এর উদ্দেশ্য হচ্ছে একজন মানুষ তার পাসপোর্ট আবেদনের প্রেক্ষিতে এই বাড়তি পুলিশ ভেরিফিকেশনটির প্রয়োজন নেই। কারণ তার পাসপোর্ট পাবার জন্য নীতিগতভাবে এই মুহূর্তে ‘জাতীয় পরিচয়পত্র’ এবং ‘জন্ম নিবন্ধন সনদপত্র’ এই দুটো ডাটাসেটে তার নাম ঠিকানা নির্ভুল থাকলে সে একটা পাসপোর্ট পাবার যোগ্যতা অর্জন করে। সেখানে সেই মানুষটা বিপদজনক অথবা অন্য কিছু আইনগত সমস্যা থাকলে সেখানে সে পাসপোর্ট ব্যবহার বন্ধ রাখার পদ্ধতি চালু করলে সেই পাসপোর্ট ব্যবহার করে কেউ দেশত্যাগ করতে পারবেন না।
এখানে ‘পার্সপেক্টিভ হচ্ছে আমাদের এতগুলো ডাটাসেট থাকতে একটা পাসপোর্ট পেতে কেন পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন পড়ছে? দেশে একটা একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতি থাকলে একজন ব্যক্তির পাসপোর্টের জন্য ৫/১০ বছর পর আলাদা আলাদা নম্বর সংরক্ষণ না করে একই পাসপোর্ট নাম্বার ব্যবহার করা যেতে পারে। সেই ইউনিক পাসপোর্ট নম্বরের পর তার বইয়ের সংখ্যা বাড়বে সময়ের সাথে সাথে। যেমন, আমার পাসপোর্ট নম্বর ৯৮৭৬৫৪৩২ হলে তার বই নম্বর ৯৮৭৬৫৪৩২/০১, ০২, ০৩ হিসেবে বাড়তে থাকবে। একটি একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে একটাই পাসপোর্ট নম্বর ব্যবহার হবে প্রতিটা মানুষের সারা জীবনের জন্য। এতে সরকারের প্রশাসনিক জটিলতা কমে যাবে অনেক গুণ।
ইন্টিগ্রেটেড ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন এন্ড ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস’
প্রশাসন এর মধ্যেই ‘সিভিল রেজিস্ট্রেশন এন্ড ভাইটাল স্ট্যাটিস্টিকস’ বলে আলাদা অবকাঠামো তৈরি করেছে যা জাতিসংঘের ম্যান্ডেটের সাথে যায়। ফলে, এখানে ‘অফিস ইনফরমেশন সার্ভিস ফ্রেমওয়ার্কের ইন্ট্রিগেশন ‘জাতীয় সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী’, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং ‘ব্যানবেইস’ এর সংশ্লিষ্টতা ধীরে ধীরে একটা ইউনিক পরিচয়পত্রের দিকে ঝুঁকছে। বর্তমানে সবকিছু নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেজের আঙ্গিকেই সব ধরনের ইন্ট্রিগেশন হবার কারণে ‘জন্ম এবং মৃত্যু নিবন্ধন কার্যালয়’ এবং ‘বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো’র মধ্যে আরেকটা ইন্ট্রিগেশন একটা একীভূত পরিচয়পত্রের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য এবং পরিসংখ্যান ব্যুরোর সাথে ‘ইন্ট্রিগ্রেটেড এডুকেশনাল ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম’ প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের যেভাবে ইউনিক সনাক্তকরণ পদ্ধতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে সেখানে ধীরে ধীরে জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাসেট একটা একীভূত পরিচয় পত্রের দিকে মোড় নিচ্ছে। আমার ধারণা, এর সাথে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের ‘পাসপোর্ট’ এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ‘ড্রাইভিং লাইসেন্স’ ডাটাসেট যোগ হলে সেটা পরিপূর্ণতা লাভ করবে।
আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হচ্ছে, সময়ের সাথে সাথে এই জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাসেটের সাথে প্রায় সব ধরনের সার্ভিসের সংযোগের বাধ্যবাধকতা চলে আসলে এটা একটা স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠবে। তখনই হবে আসল ডিজিটাল সার্ভিস ডেলিভারি! পাঁচটি ডাটাসেট, ক. বাংলাদেশে সিভিল রেজিস্ট্রেশন এ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (সিআরভিএস), খ. জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাসেট, নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ, গ. জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, স্থানীয় সরকার বিভাগ, ঘ. ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিআরটিএ এবং ঙ. পাসপোর্ট ডাটাসেট, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর ডাটাসেটগুলো দিয়ে একটা একীভূত আইডেন্টিটি ম্যানেজমেন্ট, ডিস্ট্রিবিউটেড লেজার তৈরি করা সম্ভব এখনই, এর পেছনে থাকবে ব্লকচেইন প্রযুক্তি। আপনার ডিজিটাল 'জাতীয় পরিচয়পত্র' চলে আসবে আপনার ফোনে, সব নিরাপত্তা সহ। তখন বছরে ৪/৫টা ভোটাভুটি অসম্ভব কিছু নয়। দেশের নীতিনির্ধারণী বিষয়ে ভোট দিতে পারবেন প্রতিমাসে।