সরকারিখাতে উদ্ভাবনা স্পর্শ করবে মানুষের জীবন
সরকারিখাতে উদ্ভাবনা স্পর্শ করবে মানুষের জীবন
সরকারিখাতে উদ্ভাবনা নিয়ে আসাটা কিছুটা চ্যালেঞ্জিং তবে অসম্ভব কিছু নয়। আমি বহু দেশ ঘুরে এবং অনেক কর্তা ব্যক্তিদের কথামতো তাদের কৌশলপত্রগুলো পড়ে যেটা বুঝেছি; সরকারিখাতে উদ্ভাবনা নিয়ে আসতে পারলে এটা বিশাল একটা জনগোষ্ঠীর জীবনকে স্পর্শ করবে। মানুষের জীবনকে পাল্টে দেয়া যাবে। সে কারণে প্রাইভেট সেক্টর অথবা বিভিন্ন ব্যবসায়িক উদ্ভবনা যেভাবে পৃথিবীর মানুষের জীবনযাত্রাকে পাল্টে দিচ্ছে, সেখানে সরকারিখাতে এধরনের উদ্ভাবনা মানুষকে বিশাল প্রেরণা দিতে পারে। যেহেতু আমি সরকারে আছি প্রায় ৩০ বছর, সেখানে বিভিন্ন পর্যায়ে ছোট ছোট উদ্ভাবনাগুলো (যা ঘটেছে আমার চোখের সামনে) পাল্টে দিয়েছে মানুষের ভালো থাকার ছোট ছোট কিছু আকাঙ্ক্ষাকে। মানুষ এখন আশা করছে প্রশাসন তাদের ছোট ছোট আকুতিগুলোকে ঠিক করে দেবে।
জনগণ যখন এক্সপার্ট
Innovative governments are enhancing citizen engagement and ensuring public involvement at every stage of the policy cycle: from shaping ideas to designing, delivering and monitoring services.
-- Citizens as experts: redefining citizen-government boundaries, Embracing Innovation in Government Global Trends
‘দ্যা অর্গানাইজেশন ফর ইকনোমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট’ অর্থাৎ ‘ওইসিডি’ এই উদ্ভাবনের নিয়ে চমৎকার কিছু ধারণা দিয়েছে। বিশেষ করে সরকারি খাতে কিভাবে উদ্ভাবনা নিয়ে আসা যায়। তারা পৃথিবীর অনেক দেশের সাথে কাজ করে একটা জিনিস বুঝেছে যে, উদ্ভাবনা কখনোই একটা আলাদা বিষয় ছিল না বরং এই উদ্ভাবনা নিয়ে সরকারি খাত বিভিন্ন দেশে প্রায় চারটা পার্সপেক্টিভ নিয়ে কাজ করে দেখিয়েছে।
ক. মিশন-ভিত্তিক উদ্ভাবন: আমাদের প্রয়োজন
একটা সুস্পষ্ট ফলাফল অর্জনের জন্য একটি নির্দিষ্ট মিশন। এর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়, কি ফলাফল চাচ্ছি শেষে। এই ফলাফল অর্জনের জন্য কি ধরনের উদ্ভাবনা প্রয়োজন অথবা এর মধ্যে কি কি কাজ করতে হবে - এর সবকিছুই পড়বে এ ধরনের উদ্ভাবনার মধ্যে। যেমন ধরুন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী ব্যবস্থাপনায় কিভাবে একটা ভাতা ( বয়স্ক, বিধবা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি) তার সুবিধাভোগীর কাছে নিশ্চিতভাবে, সঠিক সময়ে, দ্রুততার সাথে সুবিধাভোগীকে কোন ধরনের ঝামেলায় না ফেলে তার দোরগোড়ায় পৌঁছানো যায় সেটাকে মিশন-ভিত্তিক উদ্ভাবনা বলা যেতে পারে।
এখানে আমি যতগুলো ‘কিওয়ার্ড’ ব্যবহার করেছি ততগুলো মাইলস্টোন অর্জনের জন্য এর মধ্যে যত ধরনের উদ্ভাবনা নিয়ে আসা দরকার সেটা করতে পারবে শুধুমাত্র সরকারি প্রশাসন। এখানে প্রতিটা পদে পদে বাধা না দিয়ে বরং কিভাবে অল্প সময়ে সবগুলো মানদণ্ড অর্থাৎ ‘ক্রাইটেরিয়া’ পূর্ণ করে সুবিধাভোগীর হাতে টাকা পৌঁছানোটাই হচ্ছে এই উদ্ভাবনার মিশন। মিশন ভিত্তিক এই ধরনের উদ্ভাবনার সবচেয়ে বড় শক্তি হচ্ছে - এর ফলাফল নিশ্চিত করার জন্য যত ধরনের আভ্যন্তরীণ এবং মধ্যবর্তী উদ্ভাবনার দরকার পড়বে সেগুলো ব্যবহার করে ফলাফল নিশ্চিত করা। যুদ্ধে যখন আমাকে একটা ‘টার্গেট’ দেওয়া হয়, তখন সেই টার্গেটকে হাতের নাগালে নিয়ে আসার জন্য যত ধরনের উদ্ভাবনার প্রয়োজন সেটা তৈরি করতে হবে আমাকে। সমস্যার কথা বলে এই কাজ থেকে বের হয়ে যাবার কোনো সুযোগ নেই।
বিশালাকার ব্যবস্থাপনা, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী
বাংলাদেশে যদি সবচেয়ে বড় ব্যবস্থাপনার কথা বলা হয় তাহলে সেটা হবে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী প্রকল্প এবং সবচেয়ে বড় এবং ঝামেলার কাজ হবে এই অসাধারণ প্রজেক্টে। সবচেয়ে বেশি মন্ত্রণালয়ের সমন্বয় দরকার এখানে। আর তাই এখানে দরকার সবচেয়ে বেশি উদ্ভাবনা। এখানে কিভাবে একটা ব্যবস্থাপনার মধ্যে একজন আসল সুবিধাভোগীকে (যিনি হতে পারেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সুবিধাগ্রহণকারী ব্যক্তি) চিহ্নিত করা যায় সেটার জন্য সত্যিকারের উদ্ভাবনা রয়েছে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র, সিভিল রেজিস্ট্রেশন এ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (সিআরভিএস) এবং জন্মনিবন্ধন যাচাই এবং সনাক্তকরণ ব্যবস্থাপনায়।
আগের ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জনপ্রতিনিধিদের ইনপুট এবং সরকারি এবং বেসরকারি ডাটার ভিত্তিতে বিভিন্ন ‘প্রক্সি মিনস’ এবং সেই এলাকার সরেজমিনে তথ্য উপাত্ত এক জায়গায় নিয়ে এসে একজন আসল সুবিধাভোগীকে সনাক্ত করা করা যাবে মেশিন লার্নিং দিয়ে। সেখানে সুবিধাভোগীর পরিবারের সদস্য এবং আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের ধারণা পাওয়া যাবে সরকারি এবং বেসরকারি বিভিন্ন ডাটা সেটে। সেকারণে লাগবে রুলসেট, প্রতি মন্ত্রণালয় থেকে। সেটাকে ট্রান্সলেট করতে হবে মনুষ্যবিহীন সিদ্ধান্ত নেবার অ্যালগরিদম। বানাবে মানুষ, তবে সেটা সিদ্ধান্ত নেবে মানুষের সাহায্য ছাড়াই। শেষ অংশে থাকতে পারেন মানুষ, বড় ধরনের ভুল আটকাতে। এটার একটা ভালো মডেল দেখতে পারেন ফিনল্যান্ডের 'কেলা' থেকে - যা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা প্ল্যাটফর্ম।
খ. ‘এনহ্যান্সমেন্ট’ অর্থাৎ বর্ধনমুখী ভিত্তিক উদ্ভাবন
এই উদ্ভাবনাগুলোতে আগের কাজের ধারা পদ্ধতিগুলোকে আপগ্রেড করবে বিদ্যমান কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে। এটা একটু কষ্টকর তবে বর্তমানের নতুন প্রজন্মের প্রশাসনের কর্মকর্তাদের এই বিদ্যমান কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে উদ্ভাবনা বের করে নিয়ে আসছেন যা আসলেই তাক লাগানোর মতো। তারা নিজেদের উদ্যোগে অনেক কিছু করেছেন সরকারের বাড়তি টাকা বরাদ্দ ছাড়াই।
স্কেলে কাজ করতে পারা
One of the trickiest aspects of government involves scale. In terms of innovation, this means establishing how to scale an innovation initiative from small to large once it has demonstrated its value.
-- Scaling government, Embracing Innovation in Government Global Trends
এই উদ্ভাবনাতে দক্ষতা এবং আরও ভাল ফলাফল অর্জন করার জন্য যত ধরনের উদ্ভাবনা দরকার সবগুলোই এখানে করা সম্ভব এবং সব ধরনের উদ্ভাবনা হচ্ছে বিদ্যমান কাঠামোর উপর ভিত্তি করে। ব্যাপারটা এরকম যে বর্তমান যে কাঠামোগুলো আছে সেই কাঠামোগুলোকে ব্যবহার করে যত ধরনের উদ্ভাবনা নিয়ে আসা যায় একটা কাজ করতে। এটা অবশ্যই আগের মিশন ভিত্তিক উদ্ভাবনার মত কঠিন না হলেও যেহেতু বিদ্যমান কাঠামোকে ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে, সে কারণে এখানে উদ্ভাবনার কিছু কিছু অংশ সীমিত হয়ে আসে। তবে, আমাদের মতো সীমিত আয়ের দেশগুলোতে এ ধরনের উদ্ভাবনার বেশি প্রয়োজন। এবং সেটাই হচ্ছে আজকের প্রশাসনে। ভূমি নিয়ে প্রচুর বর্ধনমুখী ভিত্তিক উদ্ভাবন হয়েছে যা পরে প্রশাসনের পোর্টালে আনুষ্ঠানিকভাবে এসেছে।
ইলেকট্রনিক সেবা, সনাতন নথির পাশাপাশি ইলেকট্রনিক ডকুমেন্টেশনের জন্য আইনগত ভিত্তি
সরকারের যত ধরনের সেবা রয়েছে সেগুলোকে যখন আমরা ইলেকট্রনিক সেবাতে নিয়ে যাই তখন সফট্ওয়ারে সেবাগুলোকে সহজীকরণ করলেও সরকারি নথিপত্রে সেই সহজীকরণ করা বেশ কষ্টকর। সে কারণে বর্তমানে সরকারি যত ধরনের ইলেকট্রনিক সার্ভিস আছে সেই সার্ভিসগুলোর ‘ব্যাক এন্ড’ হিসেবে প্রশাসনিক নথিপত্রগুলোকে সহজীকরণ প্রক্রিয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এই সহজীকরণ প্রক্রিয়া হচ্ছে - বর্তমান যে প্রক্রিয়াগুলো আছে সেই প্রক্রিয়াগুলো থেকে ‘এনহ্যান্সমেন্ট’ ভিত্তিক উদ্ভাবনায় বাড়তি স্টেপগুলোকে ফেলে দেয়া যেতে পারে কারণ সেগুলো ছিলো নথিভিত্তিক।
এখন কাজগুলো সফটওয়্যারে এলেও কাগজের কাজগুলোকে আইন দিয়ে কমিয়ে আনতে হবে। আইন বলে দেবে এই সফটওয়্যারের রিপোর্ট কাগজের নথির মতো পরিগণিত হবে, এবং আস্তে আস্তে একটা সময় পর সব নথি ইলেকট্রনিক হয়ে যাবে। আইন তখন ইলেকট্রনিক নথিকেই আসল ধরে নেবে। তখন আসবে ডিজিটাল সিগনেচার যা আইন হয়ে আছে অনেকদিন থেকে। প্রেরক এবং প্রাপককে সনাক্ত করতে। এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই যুগান্তকারী আইনগুলোর কথা বলা যেতে পারে।
টেন্ডারিং প্রক্রিয়া: ‘ইলেকট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট’কে ‘রুল বেইজড’ সিস্টেমে ম্যাপিং
ধরা যাক, আগে সরকারি অফিসগুলোতে যে ধরনের টেন্ডারিং প্রক্রিয়া ছিল, সেগুলোকে সফটওয়্যার এর ধারণা থেকে পরিবর্তন করে আনা হয়েছে বেশ আগেই। এখানে যারা ক্রয় সেবা গ্রহণকারী এবং যারা কিনছেন তাদের মধ্যে সংযোগ সূত্র হিসেবে কাজ করছে সেই পোর্টালটি। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেটা কতোটুকু সচ্ছতা নিয়ে এসেছে? যারা টেন্ডার পাচ্ছেন না, তাদের মতামত নেয়া হয়েছে কী? সেখানেই আসবে ওয়ার্ক-ফ্লো এর জন্য গণশুনানি, কিভাবে হওয়া দরকার, ওয়েবসাইটে দিয়ে। এখন যে কাজ হয়েছে সেটা প্রশংসার যোগ্য তবে এখানে আরও কাজ আছে সামনে। আর সেটাই উদ্ভাবনা কিভাবে আরো জনগনের কাছে পৌঁছানো যায়।
এখন উদ্ভাবনার ব্যাপারটাতে আসি। এখানে ‘ইলেকট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট’ অর্থাৎ ‘ই-জিপি’ পোর্টাল দিয়ে সব ধরনের কাজ হলেও এই কেনাকাটার প্রক্রিয়াকে ‘রুল বেইজড’ সিস্টেমে পরিবর্তন করা যেতে পারে। অর্থাৎ প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত নেবে অ্যালগরিদম। একজন মানুষ অথবা টেন্ডার ইভালুয়েশন কমিটি যেভাবে টেন্ডার প্রক্রিয়া অনুসরণ করে একজনকে কাজ দিতেন, সেই প্রক্রিয়াকে ‘রুল বেইজড’ সিস্টেমে ম্যাপিং করে দিলে অ্যালগরিদম সেই কাজটা অনায়াসে এবং আরো ভালোভাবে করতে পারবে। এখানে মানুষের যে ‘বায়াস’ সেটা কাজ করবেনা বলে পূর্ণ স্বচ্ছতা আসবে। আমাদের ভয় হতে পারে পুরো জিনিসটাকে যন্ত্রের ওপর ছেড়ে দিতে, তবে সেটা দেখার জন্য কয়েকটা পাইলট করলেই ব্যাপারটা সহজ হয়ে যাবে। শেষে মানুষ অনুমোদন দেবে তবে অ্যালগরিদমের আউটপুট না পাল্টে। ভুল হবার কারণ নেই কারণ, মানুষ বানিয়েছে রুলসেটগুলো।
অনলাইনে টানতে কিছু শতাংশ ভর্তুকি কাজ করেছে সব দেশে
সেবার ভেতরের গল্প
Innovative governments have realised that a citizen should not have to know the internal workings of complex bureaucracies to obtain the services they require.
-- Mass or personalised services: Embracing Innovation in Government Global Trends
কেনাকাটার প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে সহজীকরণ করার পূর্বশর্ত হিসেবে এখানে কিভাবে একটা সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান তাদের জিনিসপত্র কিনছেন, সেটাকে ফ্লোচার্টে ফেলে কার কোথায় অনুমোদন প্রয়োজন সে জিনিসটাকে রুলসেটে পরিবর্তন করলে এই সিদ্ধান্তে মানুষের স্পর্শ অনেক কমে আসবে। এর পাশাপাশি জনগণকে অনলাইন পোর্টালের মাধ্যমে সব কিছু করার জন্য অনুপ্রেরণা দিতে চাইলে যেই সার্ভিসটির দাম সাধারণভাবে ১০০ টাকা ধরা হলে সেটাকে কয়েক শতাংশ কমিয়ে ৯৭ টাকা করা যেতে পারে অনলাইনে সেবাটা দেবার সময়।
সরকারের প্রচুর অফিস ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে দেশজুড়ে, সেগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ খরচ অনেক বেশি। সেদিন থেকে প্রায় সবকিছুই অনলাইনে নিয়ে আসলে দেশজুড়ে সেই অফিসগুলো লাগছে না ধীরে ধীরে। সেই খরচটাকে দেয়া যায় ভর্তুকি হিসেবে সবাইকে অনলাইনে টানার জন্য। পৃথিবীর উন্নতদেশগুলোর এভাবেই সবাইকে নিয়ে এসেছে সরকারি একটা মাথায়। সরকারের একটা মাথা, হতে পারে সেটা একটা পোর্টাল, কলসেন্টার অথবা চিঠির মাধ্যমে জনগনের সাথে যোগাযোগ। প্রতিটা যোগাযোগ রেকর্ডেড, যাতে ট্র্যাক করতে পারেন সরকার এবং জনগণ।
সেবা সহজীকরণ দৃষ্টান্তের মধ্যে জনগণের সুবিধার্থে (টিসিভি, টাইম, কস্ট, ভিজিট) কমিয়ে আনা
ইতিমধ্যে এই ‘ইলেকট্রনিক গভর্মেন্ট প্রকিউরমেন্ট’ এক ধরনের সংশোধনী প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গেলেও সেটাকে আরো স্বচ্ছ এবং সহজীকরণ করার জন্য ইন্টারনেটে গণশুনানি করা যেতে পারে। এধরনের অনেকগুলো গণশুনানি করেছিলাম বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন অফিসে থাকাকালীন সময়ে। বিষয়টা অনেক স্বচ্ছ, কারণ এখানে পুরো পদ্ধতির পক্ষে এবং বিপক্ষে সবার মতামত নিয়ে সেগুলোকে ওয়েবসাইটে রাখা হয়। ফলে এ ধরনের গণশুনানির শেষে ভালো আউটকামগুলো বের হয়ে আসে।
এই পাবলিক প্রকিউরমেন্ট রিফর্ম (পিপিআর) প্রোগ্রামের আওতায় এই সম্পূর্ণ ই-জিপি সলিউশনটাকে বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ধীরে ধীরে ঠিক হয়ে আসছে। ব্যাপারটাকে সমস্ত সরকারী সংস্থাগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক করা হলে এখানে আরো অনেক সংশোধনী আসবে বলে আশা করা যায়। এখানে বিদ্যমান যে ধরনের নীতিমালা আছে সেই নীতিমালাকে আরো সংশোধন করা সম্ভব যখন এটাকে সফটওয়্যার এর প্রসেস-ফ্লো’র ধারণা থেকে দেখা হবে। সেটাই উদ্ভাবনা। আগে এনালগ পদ্ধতিতে যেকোনো কেনাকাটার প্রক্রিয়া দশটা টেবিল ঘুরলে সে ব্যাপারটিকে বর্তমান প্রশাসন গণশুনানি মাধ্যমে সফটওয়্যার ধারণা থেকে অনেকগুলো প্রক্রিয়া কমিয়ে আনা সম্ভব।
সরকারের এই সেবা সহজীকরণ দৃষ্টান্তের মধ্যে স্বচ্ছতার ভিত্তিতে জনগণের সুবিধার্থে (টিসিভি, টাইম, কস্ট, ভিজিট) কত অল্প সময়ের মধ্যে সার্ভিসটা ডেলিভারি দেওয়া যাবে, কত কম খরচে দেওয়া সম্ভব, এবং কত কম সেবাগ্রহীতা সেই অফিসে আসতে হবে সেগুলোকে সেবা সহজিকরণ দৃষ্টান্তের মতো করে তৈরি করলে পুরো প্রসেসের জন্য দুপক্ষের কাজের মধ্যে ‘অপটিমাইজেশন’ চলে আসবে। তবে এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মটিতে দরদাতাদের / দরপত্রদাতাদের সমান প্রবেশাধিকার বাংলাদেশের সরকারী ক্রয় প্রক্রিয়ায় দক্ষতা, স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সহায়তা করে।
প্রান্তিক পর্যায়ের দপ্তরের প্রয়োজনীয়তা কমবে
এই সংশোধনী ক্রয় প্রক্রিয়াতে একজন যিনি সরকারি সংস্থায় কোনকিছু সরবরাহ করবেন, তাদের প্রক্রিয়া এবং সরকারের ভেতরে যারা এই ক্রয় প্রক্রিয়া ব্যবহার করে বাছাই করবেন এসব কিছু যে ফ্লোচার্টের মাধ্যমে হবে সেগুলোকে সরকার এবং সরবরাহকারীদের মধ্যে ওয়েবসাইটে গণশুনানি করা যেতে পারে। এতে একেকটা টেন্ডারে যতটুকু স্বচ্ছতার প্রয়োজন তার পাশাপাশি সরকার সর্বনিম্ন দামে সঠিক দ্রব্যাদি পেতে পারে। স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এ ধরনের প্রক্রিয়া পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে চলছে বলে অন্য দেশের কিছু ‘বেস্ট প্রাক্টিস’ আমাদের মত করে কাস্টমাইজ করে নেয়া যায়। ‘রুল বেইজড’ প্রক্রিয়াতে মানুষের যে সময়, খরচ এবং সেই অফিসে যাবার জন্য যে প্রক্রিয়া সেগুলোকে কমিয়ে আনতে পারে খুব সহজেই। ভবিষ্যতে প্রান্তিক লেভেলের সরকারি অফিসগুলো আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যাবে এই ধরনের অটোমেশনের প্রভাবে। এই জিনিসটাই ঘটেছে পুরো পৃথিবীতে। এখানে সরকারি প্রচুর টাকা বেঁচে যাবে যার বেশিরভাগই যাবে সামাজিক নিরাপত্তা হিসাব বিবরণীতে।
গ. অ্যাডাপ্টিভ অর্থাৎ অভিযোজিত উদ্ভাবনা
আমাদের এই পরিবর্তনশীল পরিবেশে টিকে থাকার জন্য অভিযোজিত উদ্ভাবন ছাড়া গতি নেই। সেকারণে আমাদের নতুন পরিবেশ পরীক্ষা করে নতুন পদ্ধতির বের করার নাম হচ্ছে অ্যাডাপ্টিভ অর্থাৎ অভিযোজিত উদ্ভাবনা। সত্যি বলতে - মানুষ যে জিনিসটাকে সবচেয়ে বেশি ভয় পায় সেটার নাম হচ্ছে পরিবর্তন। আর একারণেই ‘চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট’ বলে আলাদা একটা বিষয় খোলা হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বিশেষ করে জানতে, কিভাবে পরিবর্তনকে ‘ম্যানেজ’ করতে হয়।
মানুষের স্বার্থে নীতিমালা
Internal regulations, procedures and structures – and the behaviours they generate – may inhibit innovation in the public sector. Innovative governments are finding ways to overcome these barriers by using approaches ranging from problem-oriented innovation teams to crossgovernment innovation networks, and from user-centred design to fostering the free-flow of data and information across and beyond the public sector.
-- Overcoming bureaucratic barriers, Embracing Innovation in Government Global Trends
সেভাবে আমাদের আশেপাশে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেলেও সরকারি নীতিমালাগুলো যখন সেই পরিবর্তনকে ‘অভিযোজন’ বা ‘এডাপটেশন’ করতে পারে না বা করতে দেরি করে, তখন সেখানে প্রশাসন উদ্ভাবনা হারায়। আমি যখন প্রতিবছর সঞ্চয়পত্র কিনি, তখন জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের ফটোকপি এবং ব্যাংক কর্তৃক সঞ্চয়পত্রের আবেদন পুরণ করে জমা দিতে হয়। এখন যেহেতু বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় পরিচয়পত্র এবং রাজস্ব বোর্ডের ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বরের ডাটাবেজ এর সাথে সরাসরি ‘অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস’ দিয়ে যুক্ত আছে সে কারণে আবেদনপত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর এবং ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর জুড়ে দিলেই কাজটা হয়ে যাওয়ার কথা।
তবে, ব্যাংকের সাথে কথা বলে জানা যায় যে আবেদনপত্রের সাথে ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর এবং জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি জমা দেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে যে ব্যাপারটা ঘটেছে যে ব্যাংক আগের মতো করেই আবেদনপত্র রাখছে ফটোকপিসহ অথচ এর মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক দুটো ডাটাসেটের সাথে সরাসরি অনলাইনে যুক্ত হয়ে পদ্ধতিগতভাবে সেবা সহজিকরণ প্রক্রিয়ায় এগিয়ে রয়েছে। এর পাশাপাশি সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তর যেখানে একটি ‘ইউনিফাইড’ আবেদনপত্র তাদের ওয়েবসাইটে রেখে দিয়েছেন, সেই ফরম পূরণ করে ব্যাংকে আবেদন করলে ব্যাংক তাদের নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে বলেন। এর অর্থ হচ্ছে যিনি নীতিমালা বানিয়ে একটা ফরম তৈরি করে দিয়েছেন আর যারা ফর্মটাকে ব্যবহার করবেন - এই দুই পক্ষের মধ্যে কোন এক পক্ষ ‘অভিযোজিত’ হননি।
এর পাশাপাশি আবেদনপত্রে দেয়া এ দুটো তথ্যের জন্য ফটোকপি দুটো বাহুল্য হিসেবে কাজ করছে। যেহেতু যিনি সঞ্চয়পত্রটি ইস্যু করছেন, তিনি আবেদনপত্রের লিখিত তথ্য দিয়ে যাচাই করে নিতে পারার কথা কারণ, বাংলাদেশ ব্যাংকের সিস্টেম দুটো ডাটাসেটে সরাসরি যুক্ত। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক নতুন পদ্ধতি তৈরি করেছেন তবে ব্যাংকগুলো সেই উদ্ভাবনায় অভিযোজিত হতে পারেননি। অর্থাৎ, ব্যাংকগুলো সেই পরিবর্তনকে অ্যাডাপ্ট করতে পারেননি।
এই উদাহরণটা সব ব্যাংকের জন্য পুরোপুরি ঠিক না হলেও এধরনের অনেক অসঙ্গতি আছে পদ্ধতিগত জটিলতার কারণে। সরকারি অনেক সিস্টেম অনলাইনে যুক্ত হয়ে নতুন উদ্ভাবনা নিয়ে এসেছেন তবে কাগজের নথিপত্র এবং ফটোকপি জমা দেবার ব্যাপারে কিছু কিছু সংস্থার শাখাগুলো সেই উদ্ভাবনার সাথে অভিযোজিত হতে পারেননি। আমার এই উদাহরণের উদ্দেশ্য হচ্ছে সরকারের এ ধরনের অনেক উদ্ভাবনা হবার পরও প্রশাসনের মাঠকর্মীরা সেভাবে অভিযোজিত হতে পারেননি। সেকারণে প্রত্যাশিত উদ্ভাবনগুলো অনুসন্ধানী ধারনায় কাজ করলে ভবিষ্যতের সব প্রতিশ্রুতিগুলোর আকার দিতে পারে।
ঘ. অ্যান্টিসিপেটরি অর্থাৎ প্রত্যাশিত উদ্ভাবন, সামনে কি হতে পারে?
হাজারো চোখ
Algorithms are developed to automatically detect situations that require government action, ranging from inappropriate behaviour in the street, key words on social media, traffic congestion or increased use of an online government service.
-- Human and machine: pairing human knowledge with innovative tools, OECD Docs
এই ধরনের উদ্ভাবনা ডাটার ভবিষ্যত দেখার সাথে মিলে যায় কারণ সামনে কি ঘটবে সেটা ধারণা করে নীতিমালা তৈরিতে নতুন নতুন উদ্ভাবনা নিয়ে আসা যায়। ধরা যাক বেসরকারি খাতে যেসব নতুন নতুন উদ্ভাবনা সামনে ঘটবে সেটাকে ‘প্রত্যাশিত’ অথবা আগে থেকে ধারণা করে (অন্যদেশ থেকেও দেখা যেতে পারে) সেটার জন্য নীতিমালায় উদ্ভাবনা আনতে পারে সরকার। আমাদের সামনে কি কি ঘটতে পারে অথবা সামনে কি কি সমস্যা আমাদেরকে বিপদে ফেলতে পারে সে ধরনের রিসার্চ করে সেই সমস্যাগুলোকে কিভাবে মোকাবেলা করা যায় সে ধরনের উদ্ভাবনা নিয়ে আসতে পারে যে কোন দেশের সরকার।
এখন যেভাবে ‘ব্লকচেইন’ প্রযুক্তি পুরো পৃথিবীতে নতুন আশা দেখাচ্ছে সেখানে আমরা এই প্রযুক্তির কিছু অবৈধ ব্যবহার দেখে এই নতুন প্রযুক্তিকে অবৈধ বলে ঘোষণা করি তাহলে দেশের এই ব্লকচেইন ভিত্তিক নতুন নতুন উদ্যোক্তা সেই রাস্তায় হাঁটা সাহস করবে না। অথচ, এই এখনকার বাস্তবতা ভিত্তিক ‘ডিস্ট্রিবিউটর লেজার’ প্রযুক্তি দিয়ে পৃথিবীর বহু দেশে অর্থনৈতিক খাতে বিশেষ করে ‘ফিনটেক’ অর্থাৎ ‘ফিনান্সিয়াল টেকনোলজি’ সেখানে প্রচুর উদ্ভাবনা চলে এসেছে। নতুন প্রযুক্তির ব্যাপারে অবশ্যই আমরা সাবধানে থাকবো তবে তার মানে এই নয় যে তাকে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। প্রতিটা প্রযুক্তির ভালো এবং খারাপ দিক রয়েছে। অনলাইন জুয়া সবসময় ছিল এবং সামনেও থাকবে। একে কমিয়ে আনার জন্য দরকার সামাজিক সচেতনেতা। প্রযুক্তিকে বন্ধ করে নয়। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে কোন প্রযুক্তিকে লম্বা সময়ের জন্য বন্ধ করা যায় না।
আমরা দেখছিলাম ‘শেয়ারিং ইকোনোমি’র জোয়ারে উবার অনেক দেশেই তাদের কার্যক্রম শুরু করেছিল। এখানে আমার প্রস্তাবনা ছিল, উবার বাংলাদেশে আসার আগেই আমাদের একটা খসড়া নীতিমালা তৈরি করে ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা উচিত ছিল। এটা সাহায্য করত আমাদের ভবিষ্যৎ উদ্যোক্তাদের যারা উবারের সমকক্ষ হয়ে উঠতে পারতো। হয়তোবা একটা গ্লোবাল কোম্পানি মিলিয়ন ডলার দিয়ে তাদেরকে কেনার চিন্তা করতো। এধরনের কাজ করেছিলাম আমি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে বসে। যেহেতু, আমরা গ্লোবাল ট্রেন্ডে উবারকে দেখছিলাম বিভিন্ন দেশের সরকারগুলোর সাথে আলোচনায় বসতে, তখনকার একটা খসড়া নীতিমালা অনেক সমস্যাই কাটাতো।
শুরুতে সেই খসড়া নীতিমালা তৈরি করে গণশুনানির জন্য ওয়েবসাইটে রাখলে সেখানে যারা ভবিষ্যৎ কোম্পানি হিসেবে বাংলাদেশে (দেশীয় উদ্যোক্তা সহ) আসত তারা তখন একটা ব্যবসায়িক ধারণা তৈরি করতে পারত। কিছু বিষয়ে মতের মিল না হলে সে ব্যাপারে সরকারের সাথে বসার একটা খসড়া ডকুমেন্ট ছিল। এটাই অ্যান্টিসিপেটরি উদ্ভাবনা। যে কারণে এ ধরনের অ্যান্টিসিপেটরি উদ্ভাবনা দরকার যখন নতুন ধরনের উদ্ভাবনা আমাদের দেশে এখনো আসেনি। তবে, আমরা সেটাকে ধারণা অর্থাৎ ‘অ্যান্টিসিপেট’ করে সেই উদ্ভাবনাকে নীতিমালায় নিয়ে আসার জন্য আরেকটা উদ্ভবনা করা যায় সরকারের পক্ষ থেকে।
এখন আসি আসল প্রস্তাবনায়। যার অনেকটাই এসেছে আমার ৩০ বছর সরকারে থাকার ধারনায়।