কনটেন্টে যান

সবার জন্য মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা, কাজে লাগবে এমন প্রয়োজনীয় শিক্ষা

দরকারি কারিগরি শিক্ষা, কর্মসংস্থানে

অধ্যাপক নিতাই চন্দ্র সূত্রধর, সদস্য, জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ প্রণয়ন কমিটি - এ নিয়ে একটা চমত্কার রিপোর্ট 1 লিখেছিলেন ৭ নভেম্বর ২০১৯, প্রথম আলো পত্রিকায়। খুব ভেতরের একটা অ্যানালাইসিস। পড়ে দেখতে পারেন। উনার ধারণার বেশ খানিকটা নিয়ে এসেছি এখানে।

বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটা বড় শতাংশ তরুণ-তরুণী হওয়ায় বাংলাদেশ একটা বড় ‘ডিভিডেন্ট’ পাচ্ছে সামনের ১০-১২ বছর। এমুহুর্তে, তাদের কর্মসংস্থান এবং আত্মকর্মসংস্থানে শুধুমাত্র সনাতন শিক্ষার গুরুত্ব দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যতে কর্মসংস্থান নিয়ে একটা বড় সমস্যা তৈরি হবে। প্রতিদিন আমি যতো চাকরির জন্য অনুরোধ পাই সেটা একটা বর্তমান চাকরির ল্যান্ডস্কেপ সম্মন্ধে ভালো ধারণা দেয়।

আমরা যেটা বলছি - বিশেষ করে, বর্তমান প্রযুক্তির উৎকর্ষে আমাদের তরুণ তরুণীগণ যদি কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব ঠিকমতো না বোঝেন, তাহলে বড় সমস্যা আমরা দেখছি সামনে। এখন, বড় বড় ডিগ্রী নিয়েও অনেকেই কর্মসংস্থান করতে পারছেন না। সেটার সাথে বাড়ছে মানসিক সমস্যা। আমার ‘শব্দের এমবেডিং প্রজেক্টর’ তাই দেখাচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে সনাতন বোর্ডের শিক্ষা কারিকুলামের পাশাপাশি যদি কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে সচেতনতামুলক কর্মসূচি প্রক্রিয়া চালু করা যেতে পারে।

কারিগরি শিক্ষার ঘাটতি বিশ্বজুড়ে

শুধুমাত্র বাংলাদেশে নয় - এই কারিগরি শিক্ষার জন্য বৈদেশিক কর্মসংস্থানে অনেক জনবল ঘাটতি আছে যা পূরণ করছে আমাদের আশেপাশের দেশ। ইউরোপ ব্যাপারটা অনেক আগেই বুঝেছে বলে তাদের সনাতন শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষা নিয়ে বিশাল প্রণোদনা দিচ্ছে। কারিগরি শিক্ষার ভেতরের ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে পৃথিবীর অনেক দেশেই। কারিগরি শিক্ষা এবং দক্ষ জনবল এই দুটোর মধ্যে সংযোগ করাতে হলে শিক্ষার গুণগত মানের দক্ষতা অর্জন প্রয়োজন।

২০: ১ অনুপাতে বৈদেশিক মুদ্রা 2

বাংলাদশে সে হিসেবে প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবলের অভাব শুনে আসছি সেই শুরু থেকে। আর সেই কারণেই আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ, বিশেষ করে শ্রীলঙ্কা এবং ভারত থেকে প্রচুর দক্ষ জনবল বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছেন। আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশের ‘ইনওয়ার্ড রেমিটেন্সে’র কথা বললে - বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি বলে ধারণা করা হয়। পার্শ্ববর্তী দেশের একজন দক্ষ জনবল আমাদের দেশ থেকে যত বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ে যান, সেখানে আমাদের অদক্ষ (স্কিলড নন) জনবল ১৫-২০ জন মিলে সেই টাকা আয় করেন। দক্ষতার অনুসারে কারিগরি শিক্ষার সেই সমানুপাতিক হার বৈষম্যমূলক। এর অর্থ হচ্ছে - একজন দক্ষ জনবল একটি কোম্পানিতে উপরের ধাপগুলোতে কাজ করে যত টাকা এই দেশ থেকে নিয়ে যান, তার ভগ্নাংশ আমাদের ‘অদক্ষ’ জনবল নিয়ে আসেন আমাদের দেশে। কারিগরী দক্ষতার অনুপাত বহুগুন। তবে, অনেক কাজ শুরু হয়েছে এখন।

প্রথম আলোর রিপোর্ট ৭ নভেম্বর ২০১৯, এর রিপোর্ট অনুযায়ী,

সরকারি ও বেসরকারি খাতে কারিগরি শিক্ষার যথেষ্ট সম্প্রসারণ হয়েছে। বর্তমানে সারা দেশে ৮ হাজার ৬৭৫টি কারগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ১২ লাখের বেশি শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। পাঁচ বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে এই স্তরে শিক্ষার্থী বাড়ছে। সরকার ২০২০ সালে মধ্যে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার হার ২০ শতাংশ (মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে) এবং ২০৩০ সালের মধ্যে এই হার ৩০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে। বর্তমানে এই হার প্রায় ১৬ শতাংশ। কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটগুলোতে চার বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো হয়। এ ছাড়া বিএম, ভোকেশনাল, কৃষি ডিপ্লোমা রয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে, যারা এসব কোর্স করছে, তাদের সহজেই কর্মসংস্থান হচ্ছে। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির মধ্যে ফারাক থাকলেও তাদের বেকার থাকতে হচ্ছে না।

প্রতিটি উপজেলায় ‘টেকনিক্যাল স্কুল এবং কলেজ’

সত্যি কথা বলতে, প্রতিটি উপজেলায় ‘টেকনিক্যাল স্কুল এবং কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রণোদনা দেওয়া যেতে পারে। আমাদের সনাতন শিক্ষা ধারায় কারিগরি এবং বৃত্তিমূলক কাজের ব্যাপারে সবারই প্রাথমিক ধারণা থাকা প্রয়োজন। বাসার ছোটখাটো দৈনন্দিন যে কারিগরি কাজ রয়েছে - সে ব্যাপারে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শেখানো যেতে পারে। যুগের চাহিদা অনুযায়ী - কম্পিউটারভিত্তিক নতুন বিষয়গুলো নিয়ে অনেক ধরনের কারিগরি শিক্ষা চালু করা যেতে পারে। এমন এক ধরনের কারিগরি শিক্ষা, যা চালু করার জন্য একজন ছাত্রছাত্রীকে সনাতন শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে যেতে হবে না। বেসিক পড়াশোনার পরে তাদের পছন্দের শিক্ষা। যেমন, ক্যালিগ্রাফি, পটারি, গাড়ির ইঞ্জিন নিয়ে পড়াশোনা, কাঠের কাজ।

‘অনানুষ্ঠানিক কাজের দক্ষতার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি

সমাজের প্রতিটা কাজের মূল্য সমান করার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রচার এবং সচেতনমূলক কর্মসূচি হাতে নেয়া যেতে পারে। এ ধরনের বৃত্তিমূলক শিক্ষার ক্ষেত্রে, বিশেষ করে যারা এ ধরনের দক্ষতাভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেবেন - তারা এ ধরনের ‘অনানুষ্ঠানিক কাজের দক্ষতা অর্জন করলেও তাদেরকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেবার ব্যবস্থা রাখা যায়।

আমি যেটা দেখেছি যে - এ ধরনের কাজে তার স্বীকৃতি ব্যবস্থা রাখা হলে শুধুমাত্র মর্যাদায় বাড়ছেন না তারা - এর পাশাপাশি দেশে এবং বিদেশে ভাল কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রে বিভিন্ন লেভেলে মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্য কারিগরি সনদপ্রাপ্তদেরকে দেশে এবং বিদেশে উচ্চশিক্ষার সুযোগ তৈরি করা যায়।

প্রযুক্তিভিত্তিক কোম্পানিগুলো সরিয়ে নিচ্ছে সনাতন উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তাদের নিয়োগ নীতিমালা থেকে

আমরা একটা জিনিস দেখেছি, আমাদের মতো দেশে এ ধরনের কারিগরি শিক্ষার ব্যাপারে শুধুমাত্র বঞ্চনা আর অবহেলা নয় - বরং যে কোন চাকরির ক্ষেত্রে একটি সাধারণ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান অন্যান্য কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকে। অনেক নিয়োগ বোর্ডে থাকার অভিজ্ঞতার ফলাফল এটা। তবে সরকারের বিভিন্ন কার্যকারিতা এ অবস্থাকে উন্নতির জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে - এ ধরনের কারিগরি শিক্ষার সম্প্রসারণ এবং মানোন্নয়নে আমাদের মানসিকতার বেশ ভালোই পরিবর্তন রয়েছে।

এ মুহূর্তে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে কারিগরি শিক্ষার দিকে ব্যাপক মনোযোগ সৃষ্টি করছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মধ্যে সনাতন স্কুল কলেজ থেকে কে কত ভালো ফলাফল নিয়ে আসছেন - তার থেকে বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন তার কারিগরি কাজের দক্ষতা নিয়ে। বিশেষ করে মানুষের মধ্যে যোগাযোগের স্কিল নিয়ে। দেশের বাইরে বড় বড় কোম্পানিগুলো সনাতন উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা তাদের নিয়োগ নীতিমালা থেকে বাদ দিয়েছেন অনেক আগেই। কারিগরী শিক্ষাই এখন মূল ভিত্তি।


  1. সবার জন্য মানসম্মত কারিগরি শিক্ষা, নিতাই চন্দ্র সূত্রধর, ৭ নভেম্বর ২০১৯, প্রথম আলো 

  2. আমার ব্যক্তিগত হিসেব