কনটেন্টে যান

সিদ্ধান্তের 'লুপ' থেকে মানুষকে বের করে আনা

সিদ্ধান্তের গাছপালা, ডিসিশন ট্রি

আচ্ছা বলুন তো, আমরা দিনে কয়টা সিদ্ধান্ত নেই? আমি যেহেতু সরকারি অফিসে কাজ করছি বেশ লম্বা সময় ধরে, আমার ধারণা - সমস্যার ‘ইউনিকনেস’ নিয়ে কথা বলা হলে প্রতিদিন ৫টার মত সমস্যার কথা বলা যায় যা আমরা 'নতুন' দেখছি। এর পাশাপাশি, প্রতিনিয়ত যে রুটিনমাফিক কাজ হচ্ছে সেটার ভ্যারিয়েশন কখনোই ১৫০টার বাইরে যাবে না। আমি একটু বাড়িয়েই বলছি - প্রায় সব অফিসকে একসাথে আনার জন্য।

এর অর্থ হচ্ছে আমরা কোন বিষয়ের জন্য ‘কি কি’ ইনপুট হলে ‘ফাইনালি’ মন্ত্রীমহোদয় কী সিদ্ধান্ত দিতে পারেন সেটা তৈরি করে ফেলেছি এর মধ্যে। এখন দরকার - পুরো ব্যাপারটাকে কোন ধরনের ডাটা ইনপুট (স্পেসিফিক ভাবে দরকার নেই) হলে সেটার আউটকাম কী হবে সেটাকে একটা 'প্রসেস ফ্লো'তে ফেলে দেওয়া। শুরুতে একটা রুল বেসজ অ্যাপ্লিকেশন, যা ডাটার সাথে সাথে বুদ্ধিমান হবে। একটা পারমিট দেবার জন্য ৬টা 'ক্রাইটেরিয়া' সেটা করতে পারে যন্ত্র মানুষের সাহায্য ছাড়াই। একটা বিমান যদি যাত্রাপথে কয়েক লক্ষ ইনপুটের উপর ভিত্তি করে প্রতি সেকেন্ডে হাজারো সিদ্ধান্ত নিয়ে অটোপাইলট ব্যবহার করে এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে চলে যেতে পারে তাহলে এই ১০/২০ টা 'ক্রাইটেরিয়া' থেকে আবেদনকারীদের মধ্যে কে পারমিট পাবেন এবং পাবেন না সেটা বের করা যন্ত্রের জন্য নস্যি।

আমি কখনোই এটাকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পর্যায়ের অ্যাপ্লিকেশন হিসেবে দেখবো না, তবে শুরুতে এ ধরনের বেসিক 'রুল বেসজ' অ্যাপ্লিকেশন দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। এতে মানুষের সিদ্ধান্ত দেবার ভীতিকর সমস্যাগুলোর পাশাপাশি বায়াসের ঝামেলা কমে আসবে। আমি ‘একে পছন্দ করি না’ অথবা ‘সে আমাকে জানায়নি’ এ ব্যাপারগুলো শুন্যের কোটায় আসতে বাধ্য।

ইফ দিস, দেন দ্যাট; এবং ফিনান্সিয়াল অ্যাপ্লিকেশন

যারা মানব মনস্তত্ত্ব নিয়ে পড়ালেখা করেছেন, তারা জানেন - মানুষ প্রতিনিয়ত সিদ্ধান্ত নিতে ভয় পান। আর সে কারণেই প্রতিনিয়তঃ যে ধরনের সিদ্ধান্তগুলো আমাদেরকে নিতে হয়, সেগুলোকে আমরা ‘অটোমেশনে’ ফেলে দেই। যেসব কাজগুলোকে আমাদেরকে বারবার অর্থাৎ প্রতিনিয়তঃ করতে হয় সেগুলোকে আমি নিজেই নিয়ে এসেছি বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনে।

এ ধরনের অনেকগুলো ‘IFTTT’ ধরনের ‘অ্যাপ’ আছে যেগুলোর মাধ্যমে ‘এটা হলে, ওটা হবে’ কাজগুলো ভালো কাজ করছে। সন্ধার সময়ে আপনা আপনি জানালার পর্দা নেমে যাবে, অথবা বিকাল ৬ টায় গিজার চালু হয়ে যাবে ইত্যাদি করছি বাসায়। আবার ধরুন, ‘দারাজে’ আমার পছন্দের কয়েকটা জিনিস আগে থেকে ‘সেট’ করা দামের নিচে চলে আসলে কিনে ফেলবে অ্যাপ। অর্থাৎ ‘ইজ দিস দেন দ্যাট’ ব্যাপারটা এখন বেশ ভালোভাবেই অনেক ক্ষেত্রে কাজ করছে। এই সিদ্ধান্তগুলোকে আমাকে নিজের থেকে নতুন করে দিতে হচ্ছে না।

দুটো বাচ্চার স্কুলের বেতন, বিভিন্ন ক্লাবের চাঁদা, মায়ের বাসার ইন্টারনেট বিল ইত্যাদি ফিনান্সিয়াল অ্যাপ্লিকেশনে ‘রুল’ হিসেবে ‘সেট’ করে দিলে প্রতিমাসের নির্দিষ্ট টাকা আপনার অ্যাকাউন্ট থেকে ‘বিইএফটিএন’ হয়ে চলে যাবে বিভিন্ন জায়গায়। প্রতিটা সমস্যাকে ইনপুট হিসেবে ধরলে সেটার আউটপুট কি হবে সেই ব্যাপারগুলোকে একটা ওয়ার্ক-ফ্লো প্রসেসে ফেলে দিলে সেই একই ধরনের সিদ্ধান্ত মানুষকে নিতে হবে না বার বার। এ কারণেই, অনেকে সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কোন জামাটা পড়বেন অথবা কোন খাবারটা খাবেন - সেগুলোকে নতুন করে সিদ্ধান্তের মধ্যে না ফেলে একই ধরনের জামা কাপড় অথবা একই খাওয়া-দাওয়া পদ্ধতিতে চলে যাচ্ছেন। বিশেষ করে - যারা অতিমাত্রায় ‘হাই-প্রোডাক্টিভিটি’ ধারনায় কাজ করেন।

'রুল বেসড' সিস্টেম

সরকারি সংস্থাগুলো চাইলে এমুহুর্তে মানুষের স্পর্শ ছাড়াই সেবা দিতে পারে। এটা পরীক্ষিত। সামনে, সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেব। এর মানে এই নয় যে আমাদের ইনফ্রাস্ট্রাকচার নেই। অবশ্যই আছে। আমরা তৈরি। পাল্টাতে হবে আমাদের মানসিকতা। যেমন - মানুষকে দিয়েই সার্ভিস দিতে হবে। অথবা যন্ত্র পারবে না। যন্ত্র মানুষের কাজ কেড়ে নেবে। কথাগুলো সত্য নয়। মানুষের প্রচুর কাজ পড়ে আছে। আমাদেরকে রি-স্কিলিং করতে হবে। তবে সেবা দেবার ব্যাপারে সেবা প্রদানকারী সংস্থার চাওয়া কাগজপত্রের জন্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে ‘অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস’ এর মাধ্যমে ভেরিফিকেশন হয়ে গেলে এখানে মানুষের কোন স্পর্শ লাগছেনা। সরকার এখনই অনেকগুলো সেবা সহজীকরণ কাজ করছেন। সেখানে এ মুহুর্তে মানুষকে লুপ থেকে ফেলে দেয়া হচ্ছে না।

সরকারকে ছোট করে নিয়ে আসার ধারণা

আমাদের বাবা-মা আজীবন হয়তোবা একই প্রতিষ্ঠান চাকরি করেছেন - যা আমাদের এই সময়ে অনেকটাই অসম্ভব ব্যাপার। ধীরে ধীরে যেখানে দক্ষতার কারণে বিভিন্ন দেশ তাদের সরকারের কাজের পরিধি কমিয়ে আনছেন, যার সোজাসাপ্টা উত্তর হচ্ছে ‘সরকারকে ছোট করে নিয়ে আসা’র ধারণা। সেই হিসেবে বেসরকারি সেক্টর সব সময় প্রানবন্ত থাকবে। সরকারকে ছোট করে নিয়ে আসার ব্যাপারটাকে এভাবে বলা যায় - কিছু কিছু বিষয়ে বেসরকারি সেক্টর ভালো, বিশেষ করে ব্যবসায়ে অর্থাৎ বিমান, রেল, গ্যাস, বিদ্যুত উত্পাদনে ভর্তুকি না দিয়ে এগুলোকে ছেড়ে দেয়া যায় বেসরকারি খাতে। এতে বাজেটের বাড়তি খরচের ওভারহেডগুলোকে ছেটে কমিয়ে আনা যায়। সামনে আসবে সামনে, মানুষ সরকারের বিভিন্ন সেবাগুলোর জন্য স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি ব্যবহার করবেন, যার অনেকটা আমরা দেখছি উন্নত দেশগুলোতে। আমরা যেভাবে কোন মানুষের স্পর্শ ছাড়াই একটা অ্যাপ দিয়ে দারাজ, পাঠাও এর সার্ভিস নিশ্চিত করছি সেভাবে বিশ্বব্যাপী সরকারের একীভূত ইন্টারফেস সেদিকে এগোচ্ছে। সেই ইন্টারফেসের পেছনে কাজ করবে 'রুল বেসড' সিস্টেম।

ধরা যাক, কাগজপত্র যাচাই এর জন্য - ট্রেড লাইসেন্স এর মূল অথবা সত্যায়িত কপি, টিআইএনের কপি, জাতীয় পরিচয়পত্রের অথবা পাসপোর্ট এর সত্যায়িত কপি, সম্পর্কিত ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের বৈধ সদস্যতা সনদের সত্যায়িত কপি ইত্যাদি ইত্যাদি অনলাইন আবেদনপত্রে 'ট্রেড লাইসেন্স' অথবা 'পরিচয়পত্রের নম্বর', 'ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের প্রদত্ত নম্বর' ইত্যাদি অনলাইন ফর্মে যোগ করে দিলেই সেবা প্রদানকারী সংস্থার ভেরিফিকেশন সিস্টেম বাকি সংস্থাগুলোর অনলাইন সিস্টেম থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেরিফাই করে নিয়ে আসতে পারবে মুহুর্তের মধ্যে। আমি নিজে ব্যাপারগুলো করেছি অনেকগুলো সরকারি ডাটাসেটে। অনেক ঝামেলা হয়েছে শুরুতে, তবে হয়েছে শেষে। সত্যি বলতে, আমরা মানি অথবা না মানি - সেবা দেবার ব্যাপারে আস্তে আস্তে মানুষ সরে যাবে লুপ থেকে। এখনই দেখুন, অনেক কিছুই চলে এসেছে অনলাইনে। আপনি 'ইন্টারঅ্যাকশন' করছেন মোবাইল অ্যাপ এবং ওয়েবসাইটের ফর্মের সাথে। আমাদের মোবাইল ফিনান্সিয়াল সার্ভিসের একাউন্ট খুলছি অ্যাপ দিয়ে।