কনটেন্টে যান

সেবা পদ্ধতি সহজীকরনের দৃষ্টান্ত এবং সিঙ্গাপুর

সেবা পদ্ধতি সহজীকরনের একটা দৃষ্টান্ত

এখানে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সহযোগিতায় সেবা পদ্ধতি সহজীকরনের বেশ কয়েকটা দৃষ্টান্ত থেকে একটা নিয়ে কথা বলতে পারি আমরা। সেবা সম্পর্কিত যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ে কাজ হয়েছে, সেগুলোর কিছুটা ধারণা এবং সেই প্রতিষ্ঠানগুলোর কোন সেবাগুলোকে সহজীকরণের জন্য নির্বাচিত হয়েছে সেটার কয়েকটা ধারণা দেখা যাবে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ওয়েবসাইটে। এর মধ্যে সহজীকরণের জন্য যেগুলো সেবা নির্বাচন করা হয়েছে তার বেশ কয়েকটা ম্যাট্রিক্স আপনারা দেখলে বুঝতে পারবেন সেগুলো নিয়ে বেশ ভালোই কাজ হয়েছে। তবে, সেবা সহজিকরণ এর দৃষ্টান্তের জন্য যে সেবাগুলো নির্বাচন করা হয়েছে তাদের বিদ্যমান সেবা কার্যক্রমের বিশ্লেষণ দেখলে সেই সেবার প্রাথমিক ধারণা এবং পরের অভিনব ধারণার সেবাটা দেখলে তার ‘অপটিমাল’ ধারণা পাওয়া যাবে।

এর পাশাপাশি ধাপ ভিত্তিক এবং কর্মকর্তা-কর্মচারী ভিত্তিক সেবা কার্যক্রমের যে বিশ্লেষণগুলো আছে সেগুলো আমাকে ভালো ভাবিয়েছে। সেবা প্রদান কর্ম ব্যবস্থায় যে ধরনের ডকুমেন্ট এবং সেই অফিস কর্তৃক বাড়তি যে দলিলাদি ব্যবহার হয় তার একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায় ওই দৃষ্টান্ত হিসেবে দেওয়া সেবার ডকুমেন্টগুলোতে। তবে, আমি নিজে যেহেতু ‘প্রসেস ইঞ্জিনীয়ারিং’ নিয়ে কাজ করছি, সেখানে যেকোনো সেবা প্রাপ্তির শর্তাবলীকে একজন নাগরিক তার নির্ধারিত ফরমে আবেদনের সময় অঙ্গীকার করলে মানুষের মধ্যে ‘ইন্টার-অ্যাকশন’ না হলেও চলে। অর্থাৎ অ্যালগরিদম নিজেই সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বাকি থাকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রের যাচাই। সেখানেও সফটওয়্যার ওস্তাদ।

এখনি অটোমেশন সম্ভব, মানুষের স্পর্শ ছাড়াই

এই অংশে সেবা প্রদানকারী সংস্থার চাহিত কাগজপত্রের জন্য বিভিন্ন সংস্থার সাথে ‘অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস’ এর মাধ্যমে ভেরিফিকেশন হয়ে গেলে এখানে মানুষের কোন স্পর্শ লাগছেনা। একটা উদাহরন দিয়েছি সামনে। ধরা যাক, কাগজপত্র যাচাই এর জন্য - ট্রেড লাইসেন্স এর মূল অথবা সত্যায়িত কপি, টিআইএনের কপি, জাতীয় পরিচয়পত্রের অথবা পাসপোর্ট এর সত্যায়িত কপি, সম্পর্কিত ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের বৈধ সদস্যতা সনদের সত্যায়িত কপি ইত্যাদি ইত্যাদি সেই আবেদনপত্রে 'ট্রেড লাইসেন্স' অথবা 'পরিচয়পত্রের নম্বর', 'ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের প্রদত্ত নম্বর' ইত্যাদি অনলাইন ফর্মে যোগ করে দিলেই সেবা প্রদানকারী সংস্থার ভেরিফিকেশন সিস্টেম বাকি সংস্থাগুলো থেকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ভেরিফাই করে নিয়ে আসতে পারবে মুহুর্তের মধ্যে। আমি নিজে ব্যাপারগুলো করেছি অনেকগুলো সরকারি ডাটাসেটে। অনেক ঝামেলা হয়েছে শুরুতে, তবে হয়েছে শেষে।

এর মানে হচ্ছে, খুবই সাধারণ একটা অ্যালগরিদম এই পুরো আবেদনপত্রের অনুমোদন দিয়ে দিতে পারে। তবে, শুরুতে মানুষের স্পর্শ বাদ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না কারণ - পুরো ব্যাপারটাকে বিশ্বাস করছি না বলে। পাইলটে স্বাক্ষরগুলোকে এক জায়গা নিয়ে ধাপে ধাপে ঢুকিয়ে অনুমোদনের ‘সিমুলেশন’ করা যেতে পারে। যে ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়েছে, সেখানে বিদ্যমান সেবার প্রসেস ম্যাপ তৈরি করতে গিয়ে আমি বুঝতে পারছিলাম বর্তমান সরকারের অনেক অফিসেই এ ধরনের প্রসেস ম্যাপ তৈরি করতে পারা উচিত এর মধ্যেই। সেই প্রসেস ম্যাপগুলোকে গণশুনানির জন্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করলে এখানে সেবা-গ্রহীতা এবং সেবা-প্রদানকারীদের মধ্যে একটা যোগসূত্র স্থাপন হতে পারে যা আমার অভিজ্ঞতায় বেশ সুখপ্রদ।

এই সেবা গ্রহণ এবং তার প্রাসঙ্গিক পদ্ধতির সমস্যা চিহ্নিত করতে গিয়ে সেবার সাথে সম্পৃক্ত কর্মকর্তা এবং সেবা-গ্রহীতা যে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করেছেন সেগুলোকে ‘প্রসেস ফ্লো’তে ফেললে বেশ ভালো একটা ধারণা চলে আসে। সেটার একটা উদাহরন আমরা নিচে দেখব। এর পাশাপাশি বিদ্যমান সেবা প্রদান ব্যবস্থার বর্তমান সমস্যাসমূহকে নিয়ে আলাপ করলে সেগুলোকে বিভিন্ন ক্যাটাগরি অনুসারে ভাগ করে আস্তে আস্তে ‘প্রসেস অফ এলিমিনেশন’ এর ধারণায় বাদ দেয়া যায়।

নিজের আবেদনপত্র নিজে তৈরি করলে সমস্যা কমে আসে

নিজেদের অ্যাপ

The Moments of Life app enabled users to register the births of their children, access their immunization records, navigate healthcare and childcare options eligible for benefits, and apply for the Baby Bonus Scheme.

-- How Singapore is harnessing design to transform government services, McKinsey Insights

এরপর সেবা সহজিকরণ প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য বিদ্যমান সমস্যার সমাধানে কর্মকর্তা এবং সেবা-গ্রহীতার প্রস্তাবনাকে প্রসেস ম্যাপে ফেলে দিলে সেখানে বেশ কয়েকটা ধাপ কমিয়ে আনা যায়। আমার অভিজ্ঞতায় এর ভেতরে ‘এসএমএস’ এবং ‘ওয়েবসাইটকে’ সংযুক্ত করলে সেখানে কয়েকটা প্রসেসিং এর অংশ কমে আসে। সেবা-গ্রহীতা ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিজের সমস্ত তথ্য পূরণ করে পাঠালে সেখানে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কমে আসে। কারণ সেটা নিজের জিনিস এবং নিজের তথ্য সবাই ঠিকভাবে পূরণ করে। এর পাশাপাশি দাপ্তরিকভাবে একজন সরকারি কর্মকর্তার মাধ্যমে সেই তথ্যকে নতুন করে সিস্টেমে ঢোকানোর প্রয়োজন পড়ে না। যারা সেবা গ্রহণ করছেন, তারা অন্যকে দিয়ে একটা সার্ভিস ফী দিয়েও সেটা করাতে পারেন। সেটাও হয়ে আসছে অনেকদিন ধরে। সেখানে সাহায্যকারীদের নাম থাকতে পারে সেই অনলাইন ফর্মে।

প্রয়োজন প্রজ্ঞা, দূর-দৃষ্টিভঙ্গির সংস্থা-প্রধান এবং সাহসী কর্মকর্তাদের

সরকারি অনেকগুলো অফিসে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, অনেক উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের দেখেছি - যাদের সামান্য প্রযুক্তিগত জ্ঞান না থাকলেও প্রজ্ঞা দিয়ে সে জিনিসগুলোকে ঠিক করে দেন। উনি যেহেতু সামগ্রিক ধারণাটা ভালো বোঝেন সেখানে প্রযুক্তিগত জ্ঞান সেভাবে না থাকলেও চলে। সেখানেই আমরা দেখেছি নতুন প্রস্তাবনার সম্ভাবনার কথা মনে রেখে অনেক সংস্থা-প্রধান ব্যাপারটিকে সহজ করে দিয়েছেন - উনারা অনেক প্রজ্ঞা সম্পন্ন। তবে অনেকে (প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন মেধাবী কর্মকর্তা) এধরনের সহজীকরণ ব্যাপারটি পুরনো ধরনের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে সে ভাবে সহজ করতে পারেননি। সেখানেও কাজ করতে হবে আমাদের, আরও বেশি করে। নষ্ট করা যাবে না সময়। এটা আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা।

তবে আমি যেহেতু নিজে সরকারি কাজের প্রসেসের সাথে সম্পৃক্ত, সেখানে বিভিন্ন সংস্থার সেবা প্রদানের প্রক্রিয়াগুলোকে সংস্কার করতে গিয়ে সেখানে বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এখানে অনেকে বলেন ‘বর্তমান প্রক্রিয়ায় সবকিছু ঠিকঠাক চলছে’ অথবা ‘যেহেতু আইনে আছে সে কারণে এই ধাপ গুলো বাদ দেওয়া যাবে না’ অথবা ‘কোন সমস্যা হলে কে দায়িত্ব নিবে?’ অথবা ‘এখানে আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত, কে এখানে সমন্বয়ের দায়িত্ব নেবে?’ আমার কথা একটাই। সেখানে 'রুল' ঠিকমতো তৈরি করলে সমস্যা হবার কথা নয়। আর, সবকিছুতেই 'পাইলট' সম্ভব। ভুল হতেই পারে শুরুতে। সেটা বোঝার জন্য 'পাইলট'। সমস্যা হলে অল্পের ওপর দিয়ে যায়। তবে, সবাই আন্তরিক হলে এ ধরনের সমস্যা কোন সমস্যাই নয়। সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব যখন সবাই চাইবেন প্রক্রিয়াগুলোকে সহজীকরণ করতে।

সরকারি কাজের খরচের হিসেব কিভাবে আসবে?

সবচেয়ে ভালো ব্যাপারটা এসেছে যখন বিদ্যমান সেবার প্রসেস ম্যাপ এবং সেবা সহজিকরণ এর জন্য অভিনব প্রস্তাবের প্রসেস ম্যাপকে আমরা পাশাপাশি দেখেছি তখন সেখানে বেশ কিছু জিনিস বাহুল্য মনে হয়েছে। অনেকে সহজীকরণ ব্যাপারটার পেছনের দর্শনটিকে ধরতে পারেননি। তবে তুলনামূলক বিশ্লেষণ, বিদ্যমান এবং প্রস্তাবিত প্রক্রিয়ার ধাপগুলোকে তুলনা করলে আমার অভিজ্ঞতা বলছে - সামনে আরও ধাপ কমে আসবে। একটু সময় লাগছে এই যা। বিশেষ করে, বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যখন ক্ষমতায়ন করা হবে। এর পাশাপাশি একটা জিনিস না বললেই নয় - সেবা-গ্রহীতার এবং যারা সেবাটা দিচ্ছেন অর্থাৎ সেবাকে প্রসেস করতে কেমন খরচ হচ্ছে সবগুলোকে মিলিয়ে সেই সেবাটির জন্য সর্বশেষ খরচের হিসাব পদ্ধতি বের করা দরকার। এখানে পুরো অফিসের খরচের বিভিন্ন কম্পোনেন্টগুলোকে যোগ করলে সেই অংশগুলোর আলাদা আলাদা খরচের হিসাব যাকে ‘লং রান ইনক্রিমেন্টাল কস্ট” হিসেবে ‘বটম আপ’ হিসেবে সেই সেবার প্রকৃত খরচ বের করে - প্রতিটি গ্রাহকের কাছে তার কত অংশ যাবে সেটা বের করা জরুরি। এটাকে আমরা ‘অপরচুনিটি কস্ট’ হিসেবে বলতে পারি।

অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত, কে সমন্বয়ের দায়িত্ব নেবে?

তবে আমি যেহেতু নিজে সরকারি অনেকগুলো কাজের প্রসেসের সাথে সম্পৃক্ত, সেখানে বিভিন্ন সংস্থার সেবা প্রদানের প্রক্রিয়াগুলোকে সংস্কার করতে গিয়ে সেখানে বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়। এখানে অনেকে বলেন, ‘বর্তমান প্রক্রিয়ায় সবকিছু ঠিকঠাক চলছে’ অথবা ‘যেহেতু আইনে আছে সে কারণে এই ধাপগুলো বাদ দেওয়া যাবে না’ অথবা ‘কোন সমস্যা হলে কে দায়িত্ব নিবে?’ অথবা ‘এখানে আরো অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান সম্পৃক্ত, কে এখানে সমন্বয়ের দায়িত্ব নেবে?’ তবে, সবাই আন্তরিক হলে এ ধরনের সমস্যা কোন সমস্যাই নয়। সমস্যা হবেই। সব সমস্যার সমাধান সম্ভব - যখন সবাই চাইবেন প্রক্রিয়াগুলোকে সহজীকরণ করতে।

সিঙ্গাপুরের ‘অনলাইন বিজনেস লাইসেন্সিং সিস্টেম’

বানিয়েছে নিজেরা

At the national level, design is . . . a core element of our nation-building. Singapore is a nation by design. Nothing we have today is natural, or happened by itself. Somebody thought about it, made it happen. Not our economic growth, not our international standing, not our multiracial harmony, not even our nationhood. Nothing was by chance.

-- Singapore’s Prime Minister, Lee Hsien Loong, 2018

তবে এ ব্যাপারে আমি বেশ কিছু দেশের ব্যবসায়িক লাইসেন্সের ব্যাপারে পড়াশোনা করেছিলাম ২০১০ সালে। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে থাকার সময়। আমার সুযোগ হয়েছিল সিঙ্গাপুরে ‘ইনফোকম ডেভেলপমেন্ট অথরিটি’র একটা রেগুলেটরি এক্সিকিউটিভ প্রশিক্ষণে যাবার জন্য। সিঙ্গাপুরের ‘অনলাইন বিজনেস লাইসেন্সিং সিস্টেম’ দেখে মনে হল তারা সবকিছুকে নিয়ে এসেছে একটা জায়গায়। একটা ‘ট্রানজাকশন’ দিয়েই সরকারের সব অফিসকে যুক্ত করে জনগণের সব আবেদনপত্র এক রাস্তায় প্রসেসিং করার সুন্দর রাস্তা।

বিশ্বব্যাংকের ‘ডুইং বিজনেস’ ইনডেক্সে আমরা কোথায়?

আর সে কারণেই বিশ্বব্যাংকের ‘ডুইং বিজনেস’ ইনডেক্সে বহু বছর ধরে এক নম্বর পদ ধরে রেখেছিল। তারা এ বছর সেটা গিয়েছে নিউজিল্যান্ডের হাতে। তবে বিশ্বব্যাংকের এই র‌্যাংকিংয়ের পেছনে সিঙ্গাপুরের বর্তমান ‘লাইসেন্স-ওয়ান’ এবং ‘গো-বিজনেস’ একীভূত প্ল্যাটফর্ম অনেক সহায়তা দিচ্ছে। বড় ব্যাপার হচ্ছে - সরকারি ২৬০ ধরনের লাইসেন্স দেয়া হয় এই একীভূত প্ল্যাটফর্ম দিয়ে, যার পেছনে যুক্ত রয়েছে ৩০টা সরকারি সংস্থা। এর মধ্যে ৮০% বেশি লাইসেন্সগুলো পেতে যেতে হয় না তাদের সরকারি অফিসে। এর পাশাপাশি যেকোনো লাইসেন্সের পূর্ণ প্রক্রিয়া, সেগুলোর আপডেট এবং লাইসেন্স বন্ধ করার সবকিছুই এই একই প্লাটফর্মে করা সম্ভব। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে - ব্যবসায়ীরা এই সিস্টেমের রেটিং ৮০ শতাংশের বেশি দিয়েছে তাদের সার্ভিসগুলো পাবার ক্ষেত্রে। আমার পরিচিত অনেক দেশি উদ্যোক্তা এখন সিঙ্গাপুরে কোম্পানি খুলতে আগ্রহী।