কনটেন্টে যান

সেবাপদ্ধতি সহজীকরণ এবং প্রসেস ম্যাপ তৈরি

বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং

'Business Process Re-engineering' is the fundamental rethinking and radical redesign of business process to achieve dramatic improvement in critical, contemporary measures of performance such as cost, quality, service and speed.

-- Hammer & Champy: p.32, 1993

‘রুল বেইজড’ সিস্টেম তৈরির আগে কী দরকার?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় সিদ্ধান্ত নেবার পূর্বশর্ত হিসেবে আমাদের প্রয়োজন ‘রুল বেইজড’ সিস্টেম। ব্যাপারটা এমন, এটা হলে ওটা হবে, প্রোগ্রামিংয়ের ‘ইফ, দেন, এলস’ এর মতো। মানুষের বানানো ‘রুল বেইজড’ সিস্টেম যেখানে সিদ্ধান্ত গ্রহণে অথবা বাছাইয়ে মানুষের কোন স্পর্শ থাকবে না। তবে একটা কার্যকর ‘রুল বেইজড’ সিস্টেম তৈরির আগে প্রয়োজন কাগজে বিদ্যমান পদ্ধতির সহজীকরণ প্রক্রিয়া। সেখানে কোথায় আছি আমরা?

জনগণের জন্য সরকারি সব সেবাগুলোকে ‘সহজীকরণ’ প্রক্রিয়ায় বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সেটার বাস্তবায়ন যে দীর্ঘসূত্রতা এবং তার ফলে যে দুর্নীতি হয় সেটা থেকে বের হবার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিভিন্ন স্তরগুলোকে কমিয়ে নিয়ে আসার কাজ চলছে। এর পাশাপাশি আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং জনগণের সরকারি দপ্তরে যাবার পর যতো হয়রানি হয় সেগুলোকে বন্ধ করার জন্য ‘জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল’ এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ম-নীতির উন্নতিসাধন - বিশেষ ক্ষেত্রে যখন যেখানে প্রয়োজন তার জন্য আইন এবং পদ্ধতির পরিবর্তন - এর একটা বড় কাজ। আইন তো বাইবেল নয় যে মানুষের সুবিধার জন্য সেটা পাল্টানো যাবে না। এর পাশাপাশি লোকবলের দক্ষতার উন্নয়ন এবং তাদের মধ্যে বিভিন্ন সংস্থার সাথে যে প্রয়োজনীয় সমন্বয়সাধন এর কথা বলা হয়েছে সেগুলো এই অংশের সাথে যুক্ত হচ্ছে।

সেবাপদ্ধতি সহজীকরণ প্রসেস ম্যাপ বিশ্লেষণ

২০১৪ সালের সচিবালয় নির্দেশমালায় ২৬০ নম্বর নির্দেশনায় নাগরিক এবং সেবা গ্রহণকারীদের সকল সেবার পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে সহজ এবং সেবা প্রদানের বিভিন্ন মাপকাঠির একটা সহজীকরণ প্রক্রিয়া তৈরি করতে হবে বলে সেটার নির্দেশনা দেখেছি আমরা। এর সাথে ২০১৫ সালে সেবা-গ্রহিতার ভোগান্তি কমানোর জন্য এবং এর সঙ্গে সব ধরনের সেবাগুলোকে সহজীকরণের জন্য বেশ কয়েকটি নির্দেশনা আছে। সরকারি কয়েকটা প্রজ্ঞাপনে দেখা যায় যে নাগরিক সেবা সহজিকরণ এবং জনবান্ধব সরকারি সেবা প্রত্যাশীদের কাছে ঠিকভাবে পৌঁছানোর জন্য সব ধরনের সেবা পদ্ধতি সহজীকরণের জন্য অনেকগুলো উদ্যোগ এ মুহুর্তে দৃষ্টান্তমূলক হিসেবে ডকুমেন্টেশন করা হয়েছে।

তবে সে ব্যাপারে সেবাপ্রদানকারী সরকারের যে প্রতিষ্ঠানগুলো আছে তাদের সেবাগুলোকে ঠিকমতো শনাক্ত করে সেই সেবার প্রদানের ক্ষেত্রে জনগণ এবং সরকারি পর্যায়ে কি কি ধরনের সমস্যা আছে সেগুলো কে চিহ্নিত করতে হচ্ছে আগে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বর্তমানে যে কাগুজে কর্মপদ্ধতি আছে সেগুলোর সমস্যাগুলোকে না বুঝে বর্তমান অর্থাৎ বিদ্যমান পদ্ধতিতে হঠাৎ করে ‘সহজীকরণ’ কাজ করতে গেলে সেটার ফলাফল ভালো আসে না। এই বিদ্যমান পদ্ধতিকে আমরা বলছি ‘অ্যাজ ইজ’।

প্রসেস-ফ্লো নিয়ে কাজ

যেখানে কার্যকর এবং নাগরিক বান্ধব সেবা পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য বর্তমানে যেই ধাপগুলো নিয়ে সংস্থাগুলো কাজ করছে সেটার ‘ফ্লো-চার্ট’ দিয়ে ভেতরের বিশ্লেষণ না করলে এনালগ পদ্ধতির সমস্যাগুলোকে ডিজিটাল পদ্ধতিতে কনভার্ট করলেও সমস্যাগুলো দূর হবে না। সেখানে যেই ‘ওয়ার্ক-ফ্লো’ নিয়ে কাজ করা দরকার, সেই প্রসেস ম্যাপ নিয়ে কাজ শুরু করেছে সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা। সেবা সহজিকরণ প্রক্রিয়ায় পূর্বে কতগুলো ধাপ ছিল এবং বর্তমানে কতগুলো ধাপ নিদেনপক্ষে প্রয়োজন এবং ভবিষ্যতে পুরো ব্যাপারটিকে ডিজিটালি অর্থাৎ সফট্ওয়ারে মাইগ্রেট করলে কতগুলো ধাপ কমিয়ে আনা যাবে সেটার একটা প্রমিত পদ্ধতি তৈরি হচ্ছে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর পরে আসবে রুল-বেইজড সিস্টেম, সেখানে মানুষ আস্তে আস্তে বের হয়ে যাবে সিদ্ধান্তের ‘লুপ’ থেকে।

সেবা সহজীকরণ ম্যানুয়াল1

এ ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে এই সহজীকরণ উদ্যোগের প্রাথমিক পর্যায়ের অংশ হিসেবে একটা ভালো ডকুমেন্টেশন তৈরি হয়েছে। সেই ডকুমেন্টেশন অনুযায়ী, বিশেষ করে তার কিছু তাত্ত্বিক অংশে রয়েছে যেখানে বেশ কয়েকটা ধাপের কথা বলা হয়েছে। যেমন ১. নাগরিক দৃষ্টিকোণ থেকে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলোকে ঠিকমতো চিহ্নিতকরণ, ২. বর্তমানে যে সেবা পদ্ধতিগুলো চলমান আছে সেগুলোর সঠিক বিশ্লেষণ, ৩. এর পাশাপাশি প্রস্তাবিত পদ্ধতির জন্য নতুন ডিজাইন, ৪. বর্তমান এবং প্রস্তাবিত নতুন পদ্ধতির মধ্যে তুলনামূলক বিশ্লেষণ যেখানে জনগণ এবং সরকারের সময়, খরচ এবং সরকারি দপ্তরে যত কম ‘ভিজিট’ অর্থাৎ আসতে হবে, ৫. দুটো পদ্ধতিকে বিশ্লেষণ করে তার সুপারিশ প্রণয়ন, ৬. সেই সুপারিশমালা অনুযায়ী যথাযোগ্য কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং শেষে ৬. সেটার বাস্তবায়ন করা খুবই জরুরী।

বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং

মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক তৈরি সেবা ‘সহজিকরণ’ ম্যানুয়ালে সেবা পদ্ধতি সহজীকরণের বেশ কিছু ধারনা দেয়া আছে। এর একটা বড় অংশ এসেছে ব্যবসায়িক পৃথিবী থেকে। বিশেষ করে দক্ষতার ‘পার্সপেক্টিভ’ থেকে। সেখানে, সেবা পদ্ধতি সহজীকরণ বলতে গ্রাহকের সন্তুষ্টি বিধান, তার প্রক্রিয়ার খরচ কমানো এবং অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিযোগীদের সাথে টিকে থাকার ধারণায় পৃথিবীর বেসরকারি সংস্থাগুলো অনেক আগে থেকেই ‘বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং’ ব্যবহার করছে। ‘ম্যাসাচুসেট্স ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ অর্থাৎ এমআইটি’র অধ্যাপক মাইকেল হ্যামার এই ‘বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং’ নিয়ে প্রথম কথা বলা শুরু করেন।

তার যুক্তি ছিল, বেশিরভাগ জায়গায় বিশেষ করে আমরা যেভাবে কর্মপদ্ধতির বিভিন্ন ধাপে যে কাজগুলো করি, তার একটা বড় অংশ গ্রাহক পর্যায়ে কোন ধরনের ভ্যালু আনে না। সেই জায়গার ‘বাহুল্য’ ধাপগুলোকে অটোমেশনে না নিয়ে এসে সরাসরি বাদ দেবার বিভিন্ন যৌক্তিকতা বলেছেন তার রিসার্চ পেপারে। যেহেতু বেসরকারি খাতে এই ‘বিজনেস প্রসেস রি-ইঞ্জিনিয়ারিং’ অনেক সুফল দিয়েছে, সে কারণে বর্তমান প্রশাসন বাংলাদেশের জন্য এই সেবা পদ্ধতি সহজীকরণকে ‘সার্ভিস প্রসেস সিম্প্লিফিকেশন’ অর্থাৎ ‘এসপিএস’ হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে এই সেবা প্রদানের প্রক্রিয়ার সাথে যারা জড়িত, তাদের সাথে বসে সেই কাজগুলোর ‘ফ্লো-চার্ট’ নিয়ে সবার সাথে আলোচনা করে, এর মধ্যে কোন ধাপ অথবা নিয়ম এবং এর সঙ্গে বিদ্যমান চর্চাগুলোকে (প্র্যাকটিস) বের করে তার মধ্যে অপ্রয়োজনীয় ধাপগুলোকে কিভাবে কমিয়ে আনা যায় সেটাই আলাপ করছি এখানে।

সার্ভিস প্রসেস সিম্প্লিফিকেশন (এসপিএস)

এর সাথে সরকার যতগুলো সেবা ‘সহজীকরণ’ করার জন্য প্রাথমিকভাবে ধারণা করছে, সেগুলোর বর্তমান বাস্তব এবং সামনের সম্ভাব্য সমস্যা, কোথায় কোথায় প্রতিবন্ধকতা হতে পারে - সেটাকে খুঁজে বের করা, পদ্ধতিগত ভাবে কোন ব্যাপারটাকে কমিয়ে সেবার বিদ্যমান পদ্ধতিকে ‘আপগ্রেড’ করে তার মানোন্নয়নে কার্যকরী পদ্ধতি বের করার এই সেবা পদ্ধতিকে ‘সেবা সহজীকরণ’ অথবা ‘সার্ভিস প্রসেস সিম্প্লিফিকেশন’ বলা যেতে পারে। এখানে তার একটা ছবি দিলে ব্যাপারটা আরো সহজ মনে হবে।

সার্ভিস প্রসেস সিম্প্লিফিকেশনের ধাপ

সেবা পদ্ধতি সহজীকরণের প্রসেস ফ্রেমওয়ার্ক

আমরা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সরকারি কাজের সব ধরনের অটোমেশনের ব্যর্থ উদাহরণগুলো দেখে কেন এগুলোর শুরুতে বর্তমান সেবা পদ্ধতিগুলোর সহজীকরণের বৈশিষ্ট্যগুলো কাজ করেনি সেগুলো জানলে আমাদের এগোনো সুবিধার হবে। যেকোনো সেবা পদ্ধতিকে সহজীকরণ করতে গেলে তাদের কিছু বৈশিষ্ট্য নিয়ে এখানে আলাপ করতে পারি। বর্তমান সেবা পদ্ধতির অবস্থা এবং সামনে আমরা কোথায় যেতে চাই সেই ‘রুল বেইজড’ অ্যালগরিদম ব্যবহার করার পদ্ধতি পর্যন্ত জানা জরুরী।

সেবা পদ্ধতি সহজীকরণে বেশ কয়েকটা ধারণা আপনাদের কাজে লাগতে পারে। আপনারা যারা সরকারি দপ্তরে গিয়ে বিভিন্ন সেবা নিয়েছেন সেটার ধারণা থেকে কয়েকটা ব্যাপার আলাপ করা যায়। নিচের ধাপগুলো দেখুন।

ক. অনেকগুলো ধাপকে এক জায়গায় নিয়ে আসা

আমরা যখন একটা বিদ্যমান প্রসেস-ফ্লোকে ঠিকমত বিশ্লেষণ করি, তখন দেখা যায় যে অনেকগুলো ছোট ছোট কাজকে এক জায়গায় এনে কয়েকটা ধাপ এবং অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা কমানো যায়। এতে মূল বিষয়টি ঠিক থাকে এবং সর্বশেষ ধাপে যে একজন সেবাগ্রহীতা তার ফলাফল পেয়ে যান।

খ. সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ক্ষমতায়ন

সেবা গ্রহীতাদের প্রতিটি আবেদনপত্র শীর্ষ কর্মকর্তার কাছে না প্রেরণ করে বিভিন্ন সেবার গুরুত্বের উপর নির্ভর করে সিদ্ধান্ত প্রদানের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে ক্ষমতায়ন করতে হবে। এতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কমানো সম্ভব এবং প্রতিটি বিষয়ের জন্য উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের জন্য অপেক্ষা না করে সেবা দ্রুত দেয়া যায়। আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি বেশকিছু সংস্থায় এই ব্যাপারটি অনেকটা নির্ভর করে সংস্থাটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের উপরে।

অনেক সংস্থায় নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা আছেন তারা পুরো সংস্থার সকল খোঁজখবর রাখতে চান, ফলে প্রতিটা চিঠি এবং আবেদনপত্র সরাসরি সর্বোচ্চ পদের মাধ্যমে অনুমোদন করা হয়। এক্ষেত্রে স্ব স্ব মন্ত্রণালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুমোদনে কোন কোন সেবা কোন পর্যায়ের কর্মকর্তার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা সম্ভব সেটাকে নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত করলে এ ধরনের ক্ষমতায়ন প্রশাসনের পক্ষ থেকে করা সম্ভব। এ ধরনের ক্ষমতায়ন পরিপত্রের মাধ্যমে না হলে সেটা বেশিদিন স্থায়িত্ব লাভ করে না।

গ. সেবা-গ্রহীতার মতামত বিশ্লেষণ করা

প্রতিটি সেবার জন্য একজন সেবাগ্রহীতা কিভাবে সেবাটা পেতে চান, বিশেষ করে সেই সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে দাপ্তরিকভাবে কি কি ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হন সে ব্যাপারে গণশুনানি হলে পুরো প্রসেস ডিজাইনে সবার কাজে লাগবে। এই প্রসেস ফ্লোতে একজন সেবা-গ্রহীতা কিভাবে সেই প্রসেসকে সহজীকরণের ধারণায় দেখেন সেই ব্যাপারে সেবা গ্রহীতাদের মতামত নিলে ব্যাপারটাকে আরও গ্রাহকবান্ধব করা সম্ভব।

ঘ. সেবার ধাপ নির্ভর করবে সেবা প্রক্রিয়ার স্বাভাবিক ক্রমানুসারে, তবে একটার পর আরেকটা নয়

সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে সবগুলো কার্যক্রম ‘একটার পর একটা’ অর্থাৎ ‘ক্রম’ অনুসারে করতে হবে - এই বিষয়টি নিরুৎসাহিত করতে হবে। বর্তমান ডিজিটাল প্রসেসে একই সাথে অনেকগুলো কার্যক্রম সমান্তরালভাবে চলতে পারে। ফলে সেবা গ্রহীতার সুবিধার কথা চিন্তা করে সেই সেবা প্রদান প্রক্রিয়া নির্ধারণ করতে হবে সমান্তরালে। একই সাথে অনেকগুলো আবেদনপত্র নথিতে দেয়া যেতে পারে এক নোটে। তবে একটা নির্দিষ্ট সংখ্যক আবেদনপত্র না হলে সেটাকে প্রসেস করা যাবে না সেটাও নয়।

ঙ. সেবা প্রদানের জন্য একাধিক পদ্ধতি প্রণয়ন

এখানে সেবাগ্রহীতার চাহিদা প্রয়োজন এবং তার সুবিধার ভিন্নতার প্রেক্ষিতে একি সরা প্রদানের একাধিক পদ্ধতি উপায় থাকতে পারে যাতে সেবা গ্রহীতা অবস্থা এবং প্রয়োজন অনুসারে তার সুবিধা অনুযায়ী সেবা প্রদান করা যায়।

চ. বিভিন্ন পর্যায়ে স্বাক্ষর এবং অনুমোদনের সংখ্যা কমানো

আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকগুলো সংস্থার বিদ্যমান পদ্ধতির ‘প্রসেস ম্যাপ’ পর্যালোচনা করে দেখেছি যে অনেকগুলো ধাপে যে স্বাক্ষর এবং অনেকগুলো অনুমোদনকারীর ধাপ রাখা হয়েছে শুধুমাত্র আবেদনপত্রকে অগ্রগামী এবং নিম্নগামী করার জন্য। এই পদ্ধতিতে মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের একটি ড্যাশবোর্ড থাকলে সেখানে পুরো দপ্তরের কোথায় কিভাবে এবং তার নিজের অনুমোদনে কোন কোন আবেদনপত্রগুলো অনুমোদন হচ্ছে সেটার একটা ভালো ধারণা পাওয়া যায়। সেখানে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা এবং নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে কর্মকর্তাদের শুধুমাত্র স্বাক্ষর (অগ্রগামী এবং নিম্নগামী করার জন্য অর্থাৎ স্বাক্ষরের জন্য স্বাক্ষর) নেবার প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আনা যায়।

শুরুর দিকে সবার স্বাক্ষর এবং অনুমোদন ডিজিটাল প্রসেসে অর্থাৎ ডিজিটাল সিগনেচার ব্যবহার করে শুরু করা যেতে পারে। যেহেতু সেবা-গ্রহীতা সেবা প্রাপ্তির শর্তাবলী মেনেই আবেদন করছেন সেখানে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই করার জন্য দুটো ধাপে যাচাই এবং অগ্রগামী করা যেতে পারে। পরবর্তী পর্যায়ে সবার ডিজিটাল সিগনেচার দিয়ে সফট্ওয়ারে অগ্রগামী করা যেতে পারে। যিনি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার অনুমোদন দিতে পারবেন না অর্থাৎ উনি অথবা উনার অনুপস্থিতিতে যিনি কাজ করছেন তার ব্যাপারে প্রশাসন নিয়মমাফিক ব্যবস্থা নিতে পারেন।

ছ. আবেদনপত্রের সাথে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র উত্থাপনের প্রয়োজন কমে আসবে সামনে

আমার সরকারি পর্যায়ে অনেকগুলো জাতীয় ডাটাসেটের সাথে কাজ করার অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায় - প্রতিটি কাগজপত্র সত্যায়িত অথবা মূল কপি যা জমা দেওয়া হয়, সেগুলো অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে খুব সহজেই জাল করা যায়। একারণে সরকারি সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলো ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল ডিজিটাল আর্কিটেকচার’ অর্থাৎ ‘বিএনডিএ’ (ডাটাহাব অথবা ই-সার্ভিস বাস, যেখানে সব ধরনের ডাটাসেটগুলো নিজেদের অথোরাইজেশন এর ভিত্তিতে ডাটা এক্সচেঞ্জ অর্থাৎ আদান-প্রদান করতে পারে) অর্থাৎ যেখানে সব ধরনের ডাটাসেটের ‘অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস’ দিয়ে সব সংস্থা তাদের কাগজপত্রগুলো জমা নেবার সময়ই যাচাই করে নেবেন অনলাইনে। একটি আবেদনপত্র তখনই প্রসেস হবে যখন প্রসেসিং সফটওয়্যার প্রতিটা সংস্থার ডাটাসেট থেকে নিশ্চিত হবে। এতে খুব বেশি রিসোর্স এর প্রয়োজন পড়ে না।

ঝ. প্রয়োজনীয় সেবাকেন্দ্র স্থাপন এবং আবেদনপত্রের প্রত্যায়ন প্রদান

যে সেবাটি গ্রহণের জন্য সরাসরি একটি সেবা কেন্দ্রে (যেমন, হাসপাতাল) যেতে হবে সেখানে সেবাকেন্দ্র স্থাপন করা যায়। তবে সরকারি বেশিভাগ নিবন্ধন, সনদপত্র, পারমিট, অনাপত্তিপত্র, ছাড়পত্রগুলোর জন্য ইলেকট্রনিক্যালি একটা পোর্টালের মাধ্যমে আবেদন গ্রহণ এবং ফিরতি ইমেইল অথবা ‘এসএমএসে’ তার প্রত্যায়ন পত্র দেয়া বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। এই প্রত্যয়নপত্র ব্যবহার করে একজন সেবা-গ্রহীতা তার সেবার কার্যক্রম ‘ট্র্যাকিং’ করতে পারবেন।

ঞ. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সেবা প্রদানের বাধ্যবাধকতা তৈরি

সিটিজেন চার্টার এবং সংস্থাটির কাজের প্রকৃতি অনুযায়ী প্রতিটি সেবার জন্য একটি নির্দিষ্ট টাইমলাইন উল্লেখ থাকবে যা সেবা প্রদানকারী সকল কর্মকর্তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সেবা প্রদান করা সম্ভব না হয় তখন নির্দিষ্ট সময়ের আগে সেবা-গ্রহীতাকে জানাতে হবে তার কারনসহ।

ট. যে পদ্ধতিতে নাগরিকের প্রত্যাশা পূরণ হয়, সে ধরনের প্রক্রিয়াগুলোকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া

সেবা প্রদানের জন্য সেবা গ্রহণকারী অর্থাৎ নাগরিক যাতে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী সেবাটি পায় সেই প্রক্রিয়াকে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। এতে একটি বিদ্যমান পদ্ধতিকে যদি মানোন্নয়ন অথবা ‘আপডেট’ এর প্রয়োজন হয়, সেটা সংস্থাপ্রধান এর অনুমোদনক্রমে পদ্ধতিকে পাল্টানো যেতে পারে।

ড. সেবা প্রক্রিয়াকে সহজ, ঝামেলামুক্ত এবং কম সময়ে দেবার জন্য প্রয়োজনীয় পরিপত্র/আইন/বিধি/বিধান এর প্রয়োজনীয় পরিবর্তন

যেকোনো সেবা প্রদানের প্রক্রিয়া চিরন্তন নয় বলে একটি সেবা দেয়ার প্রেক্ষিতে যখন নতুন কোন ধারণা চলে আসে যার মাধ্যমে সেবা প্রক্রিয়াটি সহজ, ঝামেলামুক্ত এবং কম সময়ে দেওয়া সম্ভব তখন সেই সেবার জন্য প্রয়োজনীয় আইন ও বিধিমালা পরিবর্তন করতে হবে। এর সঙ্গে তার অপ্রয়োজনীয় কাজ ধাপ অথবা যেই পুরানো চর্চাগুলো (প্র্যাকটিস) যা এখনো রয়ে গেছে সেগুলোকে কমিয়ে আনতে হবে।

ঢ. সেরা এবং লাইসেন্সবিহীন ওপেনসোর্স প্রযুক্তির ব্যবহার

সেবা প্রদান পদ্ধতি পরিবর্তনের জন্য পৃথিবীর সেরা প্রযুক্তি অথচ যার বাস্তবায়ন খরচ কম সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখতে হবে। আমার অভিজ্ঞতায় পৃথিবীব্যাপী এখন ওপেনসোর্স অথবা মুক্ত কোডের প্রচুর সফটওয়্যার আছে যেগুলোকে ব্যবহার করে অনেক বড় বড় প্ল্যাটফর্ম তাদের সার্ভিস দিচ্ছে। গুগল, ফেসবুক, আমাজন থেকে শুরু করে সব বড় ছোট কোম্পানিগুলো আস্তে আস্তে ওপেনসোর্স সফট্ওয়ারে চলে আসছে।

সেখানে লাইসেন্সধারী সফটওয়্যার যা আমাদের মতো দেশে ব্যবহারের জন্য এখন প্রযোজ্য নয়। প্রচুর দেশীয় কোম্পানির দাঁড়িয়ে গেছে যারা ওপেনসোর্স প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাৎসরিক ভিত্তিতে সার্ভিস দিতে পারেন। লাইসেন্সধারী সফটওয়্যার এবং প্ল্যাটফর্মের জন্য প্রতিবছর ‘অ্যানুয়াল মেইনটেনেন্স কন্ট্রাক্টে’র নামে যত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ হয় তার সিকিভাগ খরচ করে দেশীয় ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠান দিয়ে একই স্কেলের সফটওয়্যার তৈরি এবং রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব। আমার ৩০ বছরের সরকারি অভিজ্ঞতা তাই বলে। সফটওয়্যারের লাইসেন্স যদি পুরো ইনভেস্টমেন্টের একটা বিশাল অংশে চলে যায় তাহলে সেই ইনভেস্টমেন্ট গলদ রয়েছে। আমার ভালো লাগছে এ কারণে, প্রশাসন বাংলাদেশি অনেকগুলো কোম্পানিকে দিয়ে গভর্মেন্ট ‘ইআরপি’ অর্থাৎ ‘জিআরপি’ তৈরি করেছে - যার সুফল পাচ্ছে বর্তমান প্রশাসন।

সেবা সহজীকরণের একটা সচিত্র উদাহরণ

আমলাতন্ত্র এবং বুলডোজার

Bureaucracy is an obstacle to be conquered with persistence, confidence, and a bulldozer when necessary.

-- Peter's Laws #15

আমরা অনেক গল্প করেছি তবে এর ভেতরের সহজীকরণ কিভাবে আসছে সেটা নিজে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। প্রসেস অটোমেশন, সার্ভিস সিম্প্লিফিকেশন এর জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ যে কাজ হাতে নিয়েছেন তা প্রশংসা পাবার যোগ্য। আমার শরীরের লোম খাড়া হয়ে গিয়েছিলো এর অসাধারণ কাজটা দেখে। খুব সহজ, তবে সেটা করতে লেগেছে বহু বছর। এখানে সেবার নাম ছিল: সাধারণ চিকিত্সা অনুদান। আপনি আগের অনুমোদন প্রক্রিয়াটা দেখুন। খুব কষ্ট লাগবে। অথচ, মানুষ মানুষের জন্য।

চিকিত্সা অনুদানের মতো জরুরি কাজে ৫০ ধাপ লাগলে সেটার সুফল আসবে কীভাবে? আমলাতন্ত্র সব জায়গায় আছে। সামরিক বাহিনী এবং সচিবালয়ের অনেকগুলো কাজে ভালো আউটপুট পেতে আমি অনেক 'অসাধারণ' নীতিনির্ধারকদের দেখেছি আমলাতান্ত্রিক এই ব্যাপারগুলোকে 'বুলডোজ' করে ঠিক করে ফেলতে দেখেছি, যখন মানুষের জীবন আগে। একদম নিয়ম নীতিমালার মধ্যে থেকে। সেখানে সামরিক বেসামরিক দুই ফুটিংয়ে কাজ করে দুপাশের ভালো খারাপ বিষয়গুলো বুঝতে পারি। সেখানে মাইন্ডসেট ঠিক করে আগালে যেকোন কিছু করা সম্ভব। আমি বিশ্বাস করি, আইন মানুষের জন্য। আইনের জন্য মানুষ নয়।

সাধারণ চিকিত্সা অনুদানের ধাপ -১ম পৃষ্ঠা
সাধারণ চিকিত্সা অনুদানের ধাপ -২য় পৃষ্ঠা
সাধারণ চিকিত্সা অনুদানের ধাপ -৩য় পৃষ্ঠা

বর্তমান ধাপ কী হতে পারে? ৫০টা ধাপের জায়গায় মাত্র ৬ ধাপ। এভাবে সকল সেবা অফিসগুলোতে ধাপ কমানো সম্ভব। পুরোপুরি অটোমেশনের আগেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অটোমেশনে রাষ্ট্র নিজে থেকেই জানবে আপনার কখন কিভাবে সাহায্য দরকার, চাইবার আগে। সেটার রাষ্ট্রের প্রাথমিক দ্বায়িত্ব। আমি বাড়িয়ে বলছি না। যেহেতু ডাটা নিয়ে কাজ করছি এতগুলো বছর - এটা সম্ভব। তবে, সেই পর্যায়ে যাবার আগে একটা দক্ষ অ্যানালগ সিস্টেম তৈরি করা, যাতে সেটাকে দক্ষ সফটওয়্যারে নিয়ে আসা যায়।

সাধারণ চিকিত্সা অনুদানের ধাপ -৩

সফটওয়্যার 'প্রসেসফ্লো' কথা বলবে কমন ইন্টারফেসে

আমাদের হাজারো সমস্যার সমাধান একটাই। ইন্টিগ্রেটেড 'সফটওয়্যার' সল্যুশন। না হলে এ ধরনের আরো যে ৫০ ধাপের সার্ভিস চলছে বাংলাদেশ জুড়ে, সেগুলোর আলাদা করে সমাধান করা দুস্কর। এদিকে যতোই সফটওয়্যার ব্যবহার করিনা কেন, সেই অ্যানালগ প্রসেসগুলোকে (অদক্ষ পদ্ধতি) ঠিকমতো ডিজিটালে না পাল্টালে সবাই দুষবে এই সফটওয়্যার সিস্টেমকে। আমি সেটা দেখেছি কয়েকটা জায়গায়। কিছু হলেই বলেন - সফটওয়্যার ঠিকমতো কাজ করে না। সফটওয়্যারে ঠিকমতো ইনপুট না দিয়ে সেটার দোষারোপ করা সহজ। সফটওয়্যারগুলোতে যাতে বেশি ইনপুট না দিতে হয় সেজন্য দরকার বুদ্ধিমান পদ্ধতি।

বর্তমান পদ্ধতিতে, এখনকার প্রসেসগুলোকে কনভার্ট করতে হবে এমনভাবে যেখানে 'প্রসেসফ্লো' দিক নির্দেশনা দেয় ফাইনাল আউটকামকে। আগে যেখানে ১২টা 'সাক্ষর/অগ্রগামী করা' লাগতো (কারণ - আমরা সেখানে মানুষকে ব্যবহার করছিলাম), সেখানে ৪টা ডিজিটাল সিগনেচারই পুরো সার্কেল ঘুরিয়ে আনতে পারে নিমিষে। সেখানে সব সিস্টেম কথা বলবে কমন ইন্টারফেসে। ইনফ্রাস্ট্রাকচার তৈরি হয়ে গেছে অনেক আগেই। একে ঠিকমতো 'ড্রাইভ' করতে দরকার ডাটা এবং সফটওয়্যার। এবং সেই ডাটা আছে আমাদের কাছে। দরকার বুলডোজার, এবং স্পেসিফিক টাইমলাইন।


  1. সেবা সহজীকরণ ম্যানুয়াল, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, আমার দেখা একটা 'অসাধারণ' ম্যানুয়াল, সাহায্য নেয়া হয়েছে এই চ্যাপ্টার লিখতে। আমি ধারণা করছি সেটা আরো পরিমার্জন হবে সামনের 'রুল-বেইজড' পদ্ধতির সাথে কাজ করতে।