কনটেন্টে যান

কাগজের ফটোকপির দৌরাত্ম্য, আর কতোদিন?

সবাইকে জানা

An illiterate person is one who cannot write his name, and an illiterate state is one that cannot write the names of its citizens.

– Plan Nacional Peru Contra la Indocumentacion

কেন প্রয়োজন 'একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতি'? কোথায় সাহায্য লাগবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার?

আমাকে সরকারি এবং ব্যক্তিগত প্রয়োজনে বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি অফিসে যেতে হয়। যেহেতু আমাদের প্রায় সব জায়গায় একটা বাড়তি সময় লাগে তখন সেখানে থাকাকালীন সময়টার একটা বড় সময় আমি তাদের কার্যপদ্ধতি বোঝার চেষ্টা করি। ওই জায়গাগুলোতে (আমার অফিসেও কিছু জায়গায়) যে ব্যাপারটা আমার কাছে এখনো কষ্টকর মনে হয়, সেটা হচ্ছে যে জিনিসটা স্বল্প সময়ে সার্ভিস হিসেবে ডেলিভারি দেয়া যায় সেটার জন্য সময় লাগছে মাসের-পর-মাস। আমরাও মেনে নেই সেব্যাপারগুলো বিনাবাক্যব্যয়ে।

সুখবর হচ্ছে - সরকার প্রচুর সফটওয়্যার কিনছে অটোমেশনের জন্য, তবে সেগুলোর অনেকগুলোই ঠিকমতো কাস্টমাইজেশন অথবা লোকালাইজেশন না করার ফলে আগের সিস্টেমে ইন্টিগ্রেশনে সমস্যা হয়। ফলে, সফটওয়্যারগুলো বর্তমান সিস্টেমের সাথে কাজ করতে গিয়ে কোথাও না কোথাও অসম্পূর্ণ/ইনকম্পাটিবল হয়ে থাকে। ফলে সেই সার্ভিস অথবা সফটওয়্যার থেকে আশানুরূপ সার্ভিস না পেয়ে আবার অনেকে অ্যানালগ সিস্টেম এ ফেরত যান। ডিজিটাইজেশনের এটা একটা বড় সমস্যা।

সিস্টেম থেকে সিস্টেমের সংযোগ: অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস

সিস্টেম থেকে সিস্টেম, মানে সিস্টেমগুলো নিজেদের মধ্যে ঠিকমতো কথা বলছে না বলে আমাদের সার্ভিস ডেলিভারিতে সময় কমাতে পারছি না। সরকারি বেসরকারি সব ডকুমেন্ট ই-ফাইলিং না হওয়াতে পুরো ডকুমেন্ট ইকোসিস্টেমে একটা গ্যাপ থেকে যাচ্ছে। সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করাতে সফটওয়্যার গুলোর ভিতর অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস অর্থাৎ এপিআই বিভিন্ন কোম্পানির সফটওয়্যার গুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন না হওয়াতে এই ইনকম্পেটিবিলিটি। ফলে বিলগেটসের কথা অনুযায়ী একটা দক্ষ সিস্টেম অদক্ষ প্রসেসে পড়ে আরো বেশি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে যাচ্ছে।

ফটোকপি নির্ভর ব্যক্তি সনাক্তকরণ পদ্ধতি

একটা জমির নামজারি অর্থাৎ মিউটেশন অথবা রেজিস্ট্রেশন করতে গেলে সেই ব্যক্তির সনাক্তকরণ পদ্ধতির জন্য জাতীয় পরিচয়পত্রের কপি প্রয়োজন হয়। তবে জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি যা সহজে জাল করা সম্ভব, পাসপোর্ট এর ফটোকপি অথবা ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার এর ফটোকপি যত জিনিসই জমা দেওয়া হোক না কেন সব জায়গাতেই জাল হবার সুযোগ থাকে। একটা কাজের জন্য পনেরোটা ডকুমেন্টের ফটোকপি, যার সবগুলোই জাল করা সম্ভব, সেখানে তাদের সফটওয়্যার এর সাথে একটা একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতি সংযোগ থাকলেই এই সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এখানে সরকার দুটো অফিসের মধ্যে একটা চুক্তিপত্র যার মাধ্যমে দুটো অফিস নিজেদের মধ্যে এই সনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করতে পারবে।

ইলেকট্রনিক ব্যক্তি সনাক্তকরণ পদ্ধতি

যেভাবে একটা মোবাইল ফোনের সিম কিনতে একজন ব্যক্তির আঙ্গুলের ছাপ অর্থাৎ বায়োমেট্রিক ইনফরমেশন দিয়ে কেনা যাচ্ছে সেখানে জাতীয় পরিচয় পত্রের ফটোকপি রাখা হচ্ছে সরকারি কিছু বাধ্যবাধকতার কারণে। তবে আমরা সিস্টেমে দেখেছি এই ফটোকপির প্রয়োজন নেই কারণ একটা মানুষের সব তথ্য স্টোর করা আছে জাতীয় পরিচয় পত্র সিস্টেমে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা তাদের দরকার মতো সেই সিস্টেম থেকে তথ্য নিয়ে কাজ করছে।

যেহেতু জাতীয় পরিচয় পত্র ফটোকপি জাল হয় সে কারণে, রাজউককে দেখেছি আসল পাসপোর্ট দিয়ে একজন মানুষকে শনাক্ত করতে। অর্থাৎ যে জিনিসটা জাল করা যাচ্ছে না সেটা দিয়ে শনাক্তকরণের একটা চেষ্টা। কিন্তু সবার কি পাসপোর্ট আছে? তাদের জন্য কি হবে? ভূমি অফিসের সব ধরনের সনাক্তকরণ পদ্ধতি কাজ করতে পারে যখন তাদের সফটওয়্যার কথা বলবে জাতীয় পরিচয় পত্র সিস্টেমের অ্যাপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেসে। এর মাধ্যমে সব ধরনের জালিয়াতি রোধ করা সম্ভব।

আমরা, সরকারি এবং বেসরকারি অফিসে প্রচুর সফটওয়্যার কিনছি তবে সফটওয়্যারগুলোর মধ্যে সঠিক ‘লোকালাইজেশন’ বা ‘কাস্টমাইজেশন’ (বাংলাদেশের নীতিমালা অনুযায়ী যে ধরনের প্রযোজ্যতা দরকার) না থাকার ফলে এই ব্যাপারগুলো আরো দেরি হচ্ছে। ধরুন, এই মুহূর্তে ভূমি সংক্রান্ত সবগুলো সরকারি সার্ভিস জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাবেজের সংযোগ দিয়ে শুরু করলেও সেখানে নীতিনির্ধারণীতে থাকা এবং যারা আসলে কাজটা করবেন তাদের সঠিক জ্ঞানের অভাবে এ ধরনের সমস্যা দীর্ঘ হচ্ছে। এই দীর্ঘসূত্রিতার শেষ সম্ভব যখন এই ধরনের ইমপ্লিমেন্টেশনে সঠিক জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ থাকবেন।

ডিজিটাল প্রসেস মাইন্ডসেট

প্রাইভেট সেক্টরে একই সমস্যা বিদ্যমান। জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য আমার ব্যাংকের সাথে যোগাযোগ করলাম। আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয় পত্র, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নাম্বার অথবা পাসপোর্ট এর কপি দিয়ে। সেখানে ব্যাংক জাতীয় সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য আলাদা করে আবার জাতীয় পরিচয়পত্র, ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর এর জন্য আলাদা সনাক্তকরণ কপি, অথবা পাসপোর্ট এর ফটোকপি জমা দিতে বললেন। এর পাশাপাশি আমার ব্যাংকের চেকবইয়ের কপি চাইলেন ব্যাংকের সাথে সংযোগের প্রমানের জন্য। সবশেষে এই সঞ্চয়পত্র কেনার জন্য একটা বিশাল ফর্ম লিখতে হচ্ছে যার মধ্যে সকল তথ্যই ব্যাংকে ডিজিটাল ফর্মে বিদ্যমান। আর আমি যাই জমা দিচ্ছি ফটোকপি হিসেবে সবগুলোর তথ্য জমা আছে ব্যাংকে আগে থেকেই। হয়তোবা প্রডাক্ট ম্যানেজার সময় নিয়ে ব্যাপারটাকে ঠিক প্রসেসে ফেলে ইলেকট্রনিক ফরম্যাটে ফেলছেন না।

সমস্যা একটাই। আমি অনলাইনে সঞ্চয়পত্র কিনতে চাইলে আমার সনাক্তকরণ পদ্ধতি নিয়ে সবাই বিপদে আছেন। ব্যাংকগুলোর একটা একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতি সাথে সংযোগ না থাকাতে একেক কোম্পানি একেক ধরনের নীতিমালা ব্যবহার করছেন গ্রাহককে শনাক্ত করার জন্য। আমি ক্রেডিট কার্ড অথবা এটিএম কার্ড দিয়ে অনলাইন এবং "পস মেশিন" থেকে জিনিসপত্র কিনতে পারলে এটা পারছি না কেন? আমার মনে হচ্ছে প্রসেস ডেফিনিশনে আজকের এনালগ পদ্ধতিতে থেকে ডিজিটাল প্রসেস ডিফাইন করার জন্য যেই মাইন্ডসেট দরকার সেটা বর্তমানে অনুপস্থিত।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং একীভূত পরিচয় সনাক্তকরণ পদ্ধতি

পরিচয় এবং নিরাপত্তা

Governmental and authorized institutions would still have their role in authenticating the identity information by verifying and validating the digital records to be inscribed on the blockchain. But in the majority of cases, this would only be required the first time. Similar to an official document, a blockchain-based identity proof would serve the same purpose, but with enhanced security.

-- Digital Identity: Decentralization and Self-Sovereignty, Fintech Factory

আমরা অনলাইনে কেনাকাটা করতে গেলে যেখানে সবকিছুই সহজ হয়ে গিয়েছে, কারণ অনলাইন প্লাটফর্মগুলো আমাদের সনাক্তকরণ পদ্ধতির বাইরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহায়তায় কিছু পদ্ধতি বের করে ফেলেছে তাদের সুবিধার জন্য। সেখানে আমি অনলাইনে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে এত সমস্যা হবার কথা না। এই মুহূর্তে সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে আমার ব্যাংককে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঞ্চয়পত্র সিস্টেমের ঢুকে আমার জাতীয়পত্র এবং ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর দিয়ে যথাযথ এন্ট্রি দিলে সেখান থেকে সফটওয়্যার এর এপ্লিকেশন প্রোগ্রামিং ইন্টারফেস দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্র এবং ট্যাক্স আইডেন্টিফিকেশন নম্বর এর সিস্টেমের সাথে যোগাযোগ করে সঙ্গে সঙ্গে ভেরিফাই করতে পারছে।

এর অর্থ হচ্ছে সিস্টেমগুলো ভেতরে ভেতরে কানেক্টেড, তবে ব্যাংকগুলো এখানে আলাদা ইনভেস্ট করছে না যাতে একজন গ্রাহক হিসেবে আমার বাসায় বসে অন্যান্য জিনিসের মতো ব্যাংকিং সিস্টেম থেকে সঞ্চয়পত্র কিনতে পারি। সহজ কথায় আমি যেই সনাক্তকরণ পদ্ধতির মাধ্যমে ব্যাংকে নিজের অ্যাকাউন্ট স্টেটমেন্ট অনলাইনে দেখতে পাচ্ছি, সেখানে আরেকটু সতর্কতা অবলম্বন করে এই পুরো জিনিসটা অর্থাৎ অনলাইনেই সঞ্চয়পত্র/জমিজমা কেনা সম্ভব। এতে প্রয়োজনীয় যে নীতিমালাগুলো প্রয়োজন সেগুলোর সবগুলোই বাংলাদেশে বিদ্যমান।

ডিজিটাল সিগনেচার নীতিমালা এবং তার বাধ্যবাধকতা

সমস্যা একটাই। আমাদের একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতি তৈরি হয়নি যার ওপর সবার আইনত: সংযোগ তৈরি করতে হবে। এর পাশাপাশি সনাক্তকরণ পদ্ধতির ব্যবহারে বাধ্যবাধকতা নেই সকল প্রতিষ্ঠান উপর রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান থেকে। যেকোনো মানুষের সঠিক সনাক্তকরণ পদ্ধতি ব্যবহার করার একটা বড় ‘মিসিং পিস’ হচ্ছে তার ডিজিটাল সিগনেচার। যে পদ্ধতিতে একজন বাংলাদেশের নাগরিক অনলাইনে প্রমাণ করতে পারবেন তিনি সেই ব্যক্তি, যিনি সরকার অথবা বেসরকারি সিস্টেম থেকে একটা সার্ভিস পেতে ইচ্ছুক। এই আইন বাংলাদেশ হয়েছে বহু আগে। নীতিমালার সঠিক এনফোর্সমেন্ট এর অভাব, কারণ সে ব্যাপারে নীতিনির্ধারণীতে বসে থাকা মানুষের বিশ্বাসের সমস্যা। উনি নিজেও বিশ্বাস করেন না সে ব্যাপারটা সম্ভব। ফলে জিনিসটাকে ঠিকমতো ব্যবহার করার জন্য ঠিক বিধিমালা আসছে না।

সরকারি নীতিমালা অনুযায়ী ডকুমেন্টের ক্লাসিফিকেশন অনুযায়ী তিন/পাঁচ/সাত বছর পর বিভিন্ন ডকুমেন্ট বিভিন্ন ফরম্যাটে ট্রানস্ফার করা যেতে পারে। কাজ শেষে সে ধরনের ডকুমেন্ট সময়ের পর পুড়িয়ে ফেলার কথা। অন্যান্য দেশের নীতিমালা অনুযায়ী কিছু কিছু ক্যাটাগরি একটা সময় পর মাইক্রোফিল্ম অথবা হার্ডকপি অথবা ই ফাইল হিসেবে ডিজিটাইজ করা যেতে পারে।

আমার দেখা মতে মোবাইল ফোন কোম্পানির সিম রেজিস্ট্রেশন ফাইল এর হার্ডকপি রাখার কথা বলা হয়েছে একটা নির্দিষ্ট অফিস থেকে। এধরনের ডকুমেন্টে ক্যাটাগরি অনুযায়ী একটা নির্দিষ্ট সময় পরে কিভাবে ডিজিটাল ফাইল ফরম্যাটের চলে যাবে সেটা নির্দেশনা আরো স্পেসিফিক করা যেতে পারে। তা না হলে প্রতিটি জায়গায় হার্ডকপি যা রক্ষণাবেক্ষণ স্টোরেজঃ ব্যয়বহুল হওয়ায় সবার সমস্যা বাড়বে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরে এই ডকুমেন্টগুলো ই-ফাইলিং এ চলে গেলে দেশের ভিতরে ডিজিটাল রেকর্ডের ব্যবহার বাড়বে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য আশীর্বাদস্বরূপ।

পাচটা ডাটাসেট1 নিয়ে আলাপ করেছি সামনে। সেটার সাথে যুক্ত হবে 'কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা'। সেটাই তৈরি করে দেবে একীভূত সনাক্তকরণ পদ্ধতি।


  1. ক. বাংলাদেশে সিভিল রেজিস্ট্রেশন এ্যান্ড ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক্স (সিআরভিএস); খ. জাতীয় পরিচয়পত্র ডাটাসেট, নির্বাচন কমিশন বাংলাদেশ; গ. জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন, স্থানীয় সরকার বিভাগ; ঘ. ড্রাইভিং লাইসেন্স, বিআরটিএ; ঙ. পাসপোর্ট ডাটাসেট, ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর